করোনা ভাবনা, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং খসড়া প্রস্তাবনা
করোনার সময়ে আমি মোট তিনটি লিখা লিখার চেষ্টা করেছিলাম এর মধ্যে দুইটি হয়তো আপনারা অনলাইন নিউজ পোর্টাল এ পড়েছেন সেই দুটি লিখা সহ একটা খসড়া প্রস্তাবনা লিখেছি, করোনার সময়ে সেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি পরিস্থিতি বোঝার এবং মোকাবেলা করার জন্য পড়াশোনা করছি। এখানে একইসাথে তিনটি লিখা দেওয়া হল।
লিখাঃ০১
করোনায় আমাদের দিনকাল নিয়ে বেশকিছুদিন থেকেই একটা লিখা গুছিয়ে লিখতে চাচ্ছিলাম কিন্তু হয়ে উঠছিল না। সেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার কারণে সময় পাচ্ছিলাম খুবই কম। অল্প কয়েকজন মানুষের উপর অনেক দায়িত্ব ছিল,আছে এবং হয়তো থাকবে। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই যে বিষয়গুলো আমাদের সামনে এসেছে সেটা হল খাদ্য সংকট। সকল শ্রেণীর মানুষই এই আশংকা করে আসছিল। যা এখন দৃশ্যমান। এর বাইরেও কিছু বিষয় নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে, যেমন ধরেন করোনার মোকাবেলা কিভাবে সম্ভব? আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই এ ব্যাপারে একমত, প্রচুর পরীক্ষা করেই কেবল করোনা সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শুধু প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল ব্যাপারটা এমন না বরং অবহেলা এবং অসচেতনতাও ছিল। খাদ্য সংকট যে আসন্ন সে ব্যাপারেও বিভিন্ন রকমের কথা শোনা গেছে দায়িত্বশীল মহলের কাছ থেকে, মাঝে মাঝে এমন মনে হয়েছে তারা নিজেরাই এ ঘটনা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকেফহাল নন। সরকারের একটা সুনির্দিষ্ট অবস্থান পরিষ্কার না করার কারণে জল এখন অনেক ঘোলাটে। এই দূর্যোগ যেহেতু ইতিপূর্বের সকল দূর্যোগ হতে আলাদা ফলে এর সঙ্গে বোঝাপড়ার ধরণটাও সঙ্গত কারণে আলাদা। সারা পৃথিবী জুড়ে যে আতংক ছড়িয়েছে তার সাথে বোঝাপড়া করতে হলে করোনা নিয়ে অন্যান্য দেশগুলীর অভিজ্ঞতাকেও গুরুত্ব দিতে হবে সেই সাথে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রচুর গবেষণা করতে হবে। গবেষণার ব্যাপারে একটা ভ্রান্ত ধারণা আমাদের মধ্যে থেকেই যাচ্ছে, গবেষণা বলতে সবাই বুঝছে করোনার প্রতিষেধক বা ওষুধ নিয়ে গবেষণা কিংবা ভেন্টিলেটর বানানো। এগুলো করোনা রোগীকে বাঁচানোর গবেষণা কিন্তু সামগ্রিক ভাবে পুরো দেশের যে ব্যাপারগুলোর সাথে সমঝোতা করতে হবে তা নিয়েও গবেষণা এবং পূর্বানুমান প্রয়োজন। করোনা শুধু মাত্র একটা মহামারী নয় বরং একটা রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক ঘটনাও। পুরো পৃথিবীর ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার মতো এক যুদ্ধ পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি কোন রাষ্ট্র-সংঘ-রাজনৈতিক দল-সামাজিক সংগঠনের পক্ষে একা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এটা একটা বৈশ্বিক ঘটনা ফলে এর মোকাবেলাও সামগ্রিক একটা ঐক্যের মাধ্যমে করতে হবে।
ফিরি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে, করোনার কারণে যে অর্থনৈতিক ধ্বসের কথা বিভিন্ন মহলের মানুষ বলে আসছিলেন তা কেবল মাত্র চ্যারিটি বা দাতব্য কাজ দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। যে ফাঁক-ফোঁকড় গুলো স্বাধীনতার পর গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কাঠামোতে তৈরি হয়েছিল তা করোনার কারণে এখন বেশ ভাল ভাবেই দৃশ্যমান। এর একটা উদাহারন হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা খাতের ব্যর্থতা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই সময়ে যে ভুমিকা পালন করার কথা ছিল তা কেবল মাত্র সম্ভব ছিল যদি স্বাস্থ্য সেবা খাতকে রাষ্ট্রীয় ভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হতো। আমাদের আমলা-মন্ত্রী-বিত্তশালী অংশ অসুস্থ হলেই বিদেশ ভ্রমণের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে এতোকাল চালিয়ে এসেছেন ফলে এখানে স্বাস্থ্য সেবা খাতে একটা মাৎসোন্যায় অবস্থা প্রকট হয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ চিকিৎসকদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এতোদিনেও স্বাস্থ্যসেবার সাথে যুক্ত নার্স-ক্লিনার-মেডিকেল এসিস্ট্যান্টরা একটা চরম ঝুঁকির মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অন্যান্য দেশে যখন দায়িত্বরত ডাক্তারের পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে তাদের জন্য সেখানে বাংলাদেশে কোন ব্যবস্থাই এখনো দৃশ্যমান নয়। খুব কাছের একজনের কাছ থেকে সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলোর অবস্থা সম্পর্কে আমার একটা ভয়াবহ ধারণাও হয়েছে। যে দায়িত্বের ভার আজকে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের নেওয়ার কথা তাতে দৃশ্যমান হচ্ছে অনেক বেশি অব্যবস্থাপনা! ত্রাণের চাল চুরি এবং উদ্ধারের চিত্র প্রতিদিনের পত্রিকায়। বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন বিভিন্নভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সরকারের স্বদিচ্ছা এবং জনগনের প্রতি দায় থাকলে আমরা হয়তো একটা সমন্বয় করার চেষ্টা বা ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করার প্রয়াস দেখতে পারতাম। সরকার টিভি কিংবা অন্যান্য গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিভিন্ন জনপ্রিয় মুখের সাহায্য নিয়ে সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে পারতেন। বিভিন্ন শ্রমজীবি মানুষ যাদের এই পরিস্থিতিতেও শ্রম দিতে হচ্ছে কোন ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই তাদের যেন কোরবানি করা হয়েছে এমন একটা ভাব সকলের মধ্যেই এমনকি এই অঞ্চলে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করা মানুষের ভেতরেও এই আলাপ সেইভাবে দেখা যায়নি। আমি কিছু আলাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তোলার চেষ্টা করেছি। ক্ষুদ্র আকারে এখানে আবার একই ব্যাপার আমি বলতে চাই,
কাওরান বাজারে আমি কিছু ছবি তুলেছিলাম আমার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে,
সারাদেশের কাঁচাবাজারের অর্থনীতি ঠিক রাখে মুলত কাওরান বাজার, এই বাজারের কাজ অনেকটা বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো যা পুরো বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করে। কাওরান বাজারে কর্মরত শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য বিকল্প কোন পদ্ধতি ভাবাই হয়নি এখনো। এখানে রাতে সারাদেশ থেকে মালামাল নিয়ে ট্রাক আসে সেগুলো লোড আনলোড করে শ্রমিকরা, এদের সাথে যুক্ত আবার অন্যান্য পেশার মানুষ যেমন চা-সিগারেট বিক্রেতা, খাবারের দোকানদার, আড়তদার, ব্যাপারী, কাঁচামালের দোকানদার। এবং নানাবিধ কারণেই এখানে সামাজিক দূরত্বের মতো ব্যাপারগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এর ফলাফল কি হতে পারে? সারাদেশের প্রত্যেক জেলা থেকে ট্রাক নিয়ে আসা চালক এবং সহকারী সহ অন্যান্য মানুষ ভোরের আগেই বাড়ি ফেরার সময় হয়তো নিজের অজান্তেই কোভিড-১৯ ভাইরাস সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন কিংবা নিজ এলাকা থেকে ভাইরাস এনে এখানে ছড়াচ্ছেন। তা আবার ঢাকা সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছড়াচ্ছে এবং সেখান থেকে ছড়াচ্ছে নানান অঞ্চলে। এই বিষয়টা যে কত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভয়াবহ তা হয়তো লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। এই মানুষ গুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা বাধ্য করে তাকে এমন ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে। এমনকি তাকে হয়তো জানতেও দেওয়া হয়না সে এই ব্যবস্থার বলী। কড়াইলে কিছুদিন কাজ করার সুবাদে একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, আমি একটা কথা করোনা দূর্যোগের শুরু থেকেই বলে আসছি,'হোম কোয়ারেন্টাইন, স্টে হোম, সোস্যাল ডিসট্যান্স শব্দগুলো সার্বজনীন নয়'কিন্তু এর ভয়াবহ সত্যতা আমি বুঝেছি কড়াইলে কাজ করার সুবাদে। বস্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং বাসস্থানের পরিবেশগত কারণেই সেখানকার মানুষের পক্ষে চাইলেই সচেতন থাকা সম্ভব না। এটা হয়তো অনেকেই বুঝবেন না কারণ চোখের পর্দা গন্ডারের সমান পুরু হয়ে গেছে।
এরপরেও আরো ব্যাপার আছে, বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশে খাদ্য সংকট প্রকট হতে পারে কৃষি ব্যবস্থায় কোন আঘাত আসলে আর আমার অনুমান সেই আঘাত এসেই গেছে। সামনের সপ্তাহে হাওড় অঞ্চলের ধান পেকে যাবে ফলে দুই-তিন দিনের মধ্যে ধান কেটে তুলতে না পারলে ধান নষ্ট হবে বিপুল পরিমানে, এর দুই-সপ্তাহের মধ্যেই উত্তরাঞ্চলের ধান কাটার মৌসুম শুরু হবে। গতবছর এমনিতেই আমরা কৃষিভিত্তিক শ্রমজীবীর সংকট লক্ষ করেছি। সেটা করোনার কারণে আরোও প্রকট হবে। এই পরিস্থিতে সেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমেও কৃষকের ধান কেটে দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা যেটা গতবছর করা হয়েছিল ফলে ফলাফল হতে পারে আরোও জটিল। এই সকল সমস্যা আরোও অনেক সমস্যা বা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সেই জটিলতা গুলোর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অন্যান্য রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি, অপুষ্টি ইত্যাদির মতো সমস্যা দেখা দিতেই পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু সংকট ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান, অনেকের সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে করোনার লক ডাউনের মধ্যেই, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা বাস করছেন এক ধরনের অনিশ্চয়তার জগতে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আছেন সেশন জটের দুশ্চিন্তায়। একটা অব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সব ক্ষেত্রেই। রাষ্ট্র যে ধরনের কাঠামোগত চর্চা করে এসেছে তা ভেঙ্গে পড়বে তাসের ঘরের মতই। ত্রাণের ট্রাক লুটের ঘটনা ভবিষ্যতে আসন্ন চুড়ান্ত সংকটকেই নির্দেশ করে। এই দূর্যোগের সময় কাজ অনেক, রাষ্ট্রীয়-ব্যক্তিগত-সাংগঠনিক ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে সেই সাথে সমন্বয়ের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। করোনা আমাদের নতুন দৃষ্টিতে সব কিছু দেখাচ্ছ-শেখাচ্ছে। এখনই সময় দুর্যোগ মোকাবেলার পাশাপাশি রাষ্ট্রের কল্যাণকর মানবিক রুপান্তর নিয়ে ভাবার এবং গবেষণা করার।
লিখাঃ০২
করোনায় কি পরিস্থিতি হতে পারে? বর্তমানে আমাদের মাথায় যেসব ব্যাপার ঘোরাফেরা করছে সেগুলো হল, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু কিংবা ক্ষুধা এবং দূর্ভিক্ষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার এক প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ লাখ থেকে বিশ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে কিন্তু শুধুমাত্র মৃতের সংখ্যা দিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা পরিমাপ করাটা বোকামি। বাংলাদেশ এমনিতেই অধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রবণ দেশ। সম্প্রতি মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করলেও জিডিপির হিসেবের বাইরেও কিছু তথ্য-উপাত্ত আছে যা আসলে ভিন্ন কথা বলে। আমি আগেও দেশের বস্তি পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু অনেকেই ভাবছেন দেশে বস্তিতে আর কতোজন মানুষ বসবাস করেন। বাংলাদেশে সর্বশেষ সরকারি বস্তি শুমারী হয় ২০১৪ সালে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই শুমারী থেকে জানা যায় ২০১৪ সালে দেশে মোট বস্তি ছিল ১৩৯৯৪ টি যার মোট জনসংখ্যা ২২ লাখ ৩২ হাজার জন। বিবিএস এর এই তথ্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। ২০১৪ সালে করা বস্তি শুমারী থেকে জানা যায় ১৯৯৭ সালের বস্তি শুমারীর তুলনায় ১৭ বছরে বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় চারগুণ। ২০২০ সালে এসে আমরা বলতেই পারি এই জনসংখ্যা আরোও বেড়েছে।
২০১৪ সালের বিবিএস এর করা জরিপ থেকে জানা যায় শুধুমাত্র ঢাকাতেই বস্তি আছে,৩৩৯৪ টি। এই বস্তিগুলোতে মোট ঘর আছে ১ লাখ ৭৫ হাজারটি এবং মোট জনসংখ্যার পরিমান ৬ লাখ। ২০১৩ সালে "মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস)" এর তথ্য অনু্যায়ী বস্তিতে বসবাসকারী পরিবার গুলোর প্রায় পচাত্তর শতাংশ একই কক্ষে বসবাস করে।
অন্যদিকে ইউনিসেফের জরিপ অনুযায়ি বস্তিতে বসবাসকারী পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্যা গড়ে ৪.৩ জন। ২০১৯ সালে এসে ইউনিসেফ বলছে, শুধুমাত্র ঢাকাতেই বস্তির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজারে এবং এর মোট জনসংখ্যা প্রায় চল্লিশ লাখ।
কেন আমরা এই পরিসংখ্যান গুলো দেখছি? কারণটা জানতে পারবেন 'কালের কন্ঠে' প্রকাশিত ২১/১১/২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে যেখানে দাবি করা হয়েছে,বস্তির প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ নূন্যতম স্বাস্থ্যসেবা এবং পর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
আমরা বলতেই পারি করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ও এই বস্তিগুলো পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার আওতার বাইরেই থেকে যাবে। আমার নিজের কাজ করার সুবাদে আমি খুবই স্বল্প আকারে একটি জরিপ চালাতে পেরেছিলাম প্রায় ২০ টি পরিবারের উপর। ১০/৪/২০২০ তারিখেই এই ২০টি পরিবারের মধ্যে ১৬ টি পরিবারের ঘরে খাবার ছিলনা এবং তারা সরকারি এবং বেসরকারি কোনও ত্রাণও পাননি। এই ২০ টি পরিবারের প্রত্যেকটিই নিম্ন আয়ের পরিবার এবং করোনায় সাধারণ ছুটি এবং একধরনের লকডাউনের কারণে পরিবারের প্রধানসহ অন্যান্য কর্মজীবি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন। যদি আমরা ইউনিসেফের দেওয়া তথ্যের দিকে তাকাই তবে দেখা যাবে শুধুমাত্র ঢাকার বস্তিতে বসবাসকারী প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বেঁচে আছেন চরম অনিশ্চয়তার ভেতর। বস্তিগুলোর বসবাসের পরিবেশের কারণেই এখানে করোনার প্রাদুর্ভাব হতে পারে মারাত্মক। খুব সঙ্গত কারণেই বস্তিগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা প্রায় অসম্ভব। একই রান্নাঘর, গণ শৌচালয় ও নলকুপের কারণে এখানে মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র ঘরে নিজেকে আটকে রাখার চিন্তাও করা যায় না। এসব কিছুর পরেও বাংলাদেশে এখন বৈশাখ মাস অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল। প্রচন্ড দাবদাহে বস্তির টিনের ঘরগুলো নরকের চেয়েও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই ঘরগুলোতে বসবাসকারী মানুষগুলো বাধ্য হয়েই গাদাগাদি করে থাকে। করোনার দিনগুলোতে বস্তিগুলোয় করোনা আঘাত হানার আগেই আঘাত হেনেছে ক্ষুধা। বস্তির মানুষের মধ্যে করোনা নিয়েও কোন সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ চোখে পড়েনি সরকারি ভাবে। বেসরকারি কিছু জায়গা থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। পরিক্ষা-নিরিক্ষা করতে আগ্রহী নয় বস্তির বেশিরভাগ মানুষ ফলে পরিস্থিতি হতে পারে আরোও ভয়াবহ। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এর মাধ্যমে আক্রান্ত হবে বেশিরভাগ মানুষ পর্যাপ্ত টেস্ট এবং চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়ার কারণে মৃত্যুর হারও হবে বেশি। ক্ষুধা এবং খাদ্যাভাব দেখা দেবে মারাত্মক আকারে। সেচ্ছাসেবী কিংবা দাতব্য প্রতিষ্ঠান গুলোর জন্যেও বস্তিতে কাজ করা হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ অথচ দায়িত্বশীল মহলের কাছ থেকে এখনো কোন কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।
কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতেও লাগতে যাচ্ছে ধাক্কা!
গত তিন-চার বছর থেকে কৃষক তার ধানের পর্যাপ্ত দাম পাচ্ছেন না, গত বছর এর ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখেছি। কৃষি শ্রমিকের সংকটও প্রকট। এবারও আমনের মৌসুমে ধানবীজের দাম কমে যাওয়ায় কৃষক বিপদে পড়েছে। ২০১৮ সালের কৃষিমন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট উৎপাদিত চালের পরিমান প্রায় ৩৩৮.০৪ লক্ষ মেট্রিক টন যার একটা বিরাট অংশ তথা ১৩৬.৫৬ লক্ষ মেট্রিক টন আসে আমন ধান থেকে। বাকিটা উৎপাদিত হয় ইরি এবং বোরো মৌসুমে। এবার করোনার আঘাত আসতে যাচ্ছে বোরো ধান কাটা এবং আমনের উৎপাদনের উপর। আগামী কাল থেকে হাওর অঞ্চলে এবংদুই সপ্তাহের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়ে যাবে। সঠিক সময়ে ধান কেটে ঘরে তুলতে না পারলে অর্থনৈতিক হুমকির মধ্যে পড়বে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০.৬ শতাংশ মানুষ যারা মূলত কৃষি নির্ভর জীবন যাপন করে। বনিকবার্তা তার প্রতিবেদনে বলছে, প্রায় ৬৬ হাজার অভিবাসি শ্রমিক লাগবে এবার হাওড় অঞ্চলে,মোট শ্রমিকের ১৮ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে এবার। পাহাড়ি ঢল এবং বন্যার সম্ভাবনা থাকায় ধান কেটে ঘরে তুলতে হবে দ্রুত। এছাড়াও আমনের উৎপাদনে করোনার ধাক্কা লাগলে দেশ একটা দীর্ঘ মেয়াদি খাদ্য সংকটে পড়তে পারে। গত তিন-চার বছরে এমনিতেই কৃষকের মাথাপিছু ঋণের পরিমান বেড়েছে তার উপর এ ধরনের ঘটনা মারাত্মক হতে পারে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে পরিস্থিতি আরোও জটিল হয়ে উঠবে। সরকারের পক্ষথেকে ৫% সুদে কৃষককে ঋণ দেওয়ার ঘোষনা আসলেও খুব আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এই ঋণের ঠিক কতটুকু প্রকৃত কৃষকের কাছে পৌছুবে তা বলা মুশকিল। এ সময়ে প্রকৃত কৃষকদের বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ কিছুটা কাজ করত। কৃষি অর্থনীতি ঠিক রাখতে যে দীর্ঘ মেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল কৃষক যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সেটা নিশ্চিত করা। এর পাশাপাশি নিরবিচ্ছিন্ন উৎপাদন যাতে নিশ্চিত হয় সেদিকে নজর দেওয়া। নয়তো ৫% সুদে দেওয়া ঋণ কৃষকের মাথায় ঋণের বোঝা বাড়া ছাড়া আর কোন লাভ হবে না।
ধাক্কা লাগবে শ্রমশক্তি রপ্তানিতেও।
২০২০ সালের প্রথম ১৫ দিনে প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে পাঠিয়েছেন ৯০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের রেকর্ড পরিমান রেমিট্যান্স। কিন্তু করোনার পৃথিবীব্যাপি আগ্রাসনে বেকার হয়ে পড়েছেন বেশিরভাগ প্রবাসী শ্রমিক। বিদেশে কর্মরত আছেন দেশের প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক। যার একটা বিরাট অংশ মধ্যপ্রাচ্যে এবং পশ্চিমা দেশগুলায়। ফলে করোনার কারণে স্তিমিত হয়ে গেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স এর অবদান ৫.৪৭ শতাংশ। এই পরিমান আরো কমলে দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। করোনা পরবর্তী পৃথিবী হয়তো নতুন কিছু সমস্যার সম্মুখীন হবে, বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শ্রমশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে একটা বড়সড় বাধা আসতে পারে। এই ব্যাপারে এখনই ভাবতে হবে নয়তো পরিস্থিতির মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
২০/০১/২০১৯ তারিখে প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ২ কোটি ৪১ লাখ হতদরিদ্র মানুষ রয়েছেন যাদের দৈনিক আয় ৬১ টাকা ৬০ পয়সার নিচে। এই মানুষগুলোর জীবন করোনা কালে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে। খাদ্য ও চিকিৎসার কোন নিশ্চয়তা নেই। নেই সরকারি কিংবা বেসরকারি দীর্ঘ মেয়াদি কোন উদ্যোগ। কিন্তু দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। পুরো ব্যবস্থাটাই দাঁড়িয়ে আছে এই হতদরিদ্র মানুষদের কাঁধে। ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় যে সংকট এবং অব্যস্থাপনা দেখা দিয়েছে তার আশু সমাধান প্রয়োজন নাহলে এপ্রিলের শেষ থেকে অবস্থা আরোও জটিল হয়ে যাবে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এ সময়টাতে করোনার প্রকোপ বাংলাদেশে সর্বোচ্চ হতে পারে।
দেশের গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত আছেন প্রায় ৪৪ লাখ মানুষ। গত ২৬ শে মার্চ থেকে শুরু হওয়া সাধারণ ছুটির কারণে এই ৪৪ লাখ মানুষ কার্যত কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। গার্মেন্টস গুলোতে শুরু হয়েছে শ্রমিক ছাঁটাই এবং লে অফ। সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণার পরেও সারাদেশ থেকে শ্রমিকদের হাঁটিয়ে তাদের কর্মস্থলে আনার সময়েও সরকারের ভুমিকা ছিল নিরব অথচ এই মানুষগুলোই জিডিপিতে অবদান রাখেন সবচেয়ে বেশি।
করোনার কারণে পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তার ভেতর টিকে থাকতে গেলে এই সময়ে এরকম হাজারটা সমস্যাকে সাহস ও স্বদিচ্ছা নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে সরকারের। সিন্ডিকেট ব্যবসার মাধ্যমে এবং সামনে রোজায় মানুষকে জিম্মি করে কেউ যাতে ফায়দা লুটতে না পারে তার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি প্রয়োজন নয়তো করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি হবে চরম মাত্রায় ভয়াবহ। দেশ আবার একটা দীর্ঘকালিন সময়ের জন্য পিছিয়ে পড়বে। এই সময়ে দূর্নীতি রোধ করে সকল কার্যক্রম পরিচালনাই সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
খসড়া প্রস্তাবনাঃ
আমার এর আগের দুটি লিখায় আমি দেখাতে চেয়েছি বাংলাদেশের অর্থনীতি সহ সামগ্রিক পরিস্থিতি কোন কোন সমস্যায় পড়তে পারে। লিখা দুটি পরে অনেকেই আমার কাছে সমাধান জানতে চেয়েছেন। আসলে এই ধরনের একটা সম্পূর্ণ নতুন সমস্যার হুট করে সমাধান দেওয়া আদৌ সম্ভব নয় বরং কিছু সম্ভাবনার কথা বলা যেতে পারে। অনেকেই করোনা দূর্যোগের সমাধান হিসেবে লকডাউন কে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে লকডাউনের সাথে জড়িত অন্যান্য ঘটনাগুলো ছাড়া শুধু লকডাউনের মাধ্যমে এর মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। বরং কিছুটা হাস্যকর ব্যাপার। গত কিছুদিন ধরেই ভারতের "কেরালা" রাজ্য ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। কেরালা লকডাউনের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য নিশ্চিত করতে পেরেছিল জন্যেই তাদের এই সামগ্রিক সাফল্য। এন্টিবডি টেস্ট করার মাধ্যমে করোনা আক্রান্তদের শনাক্ত করা, ডিজিটাল সার্ভিল্যান্স এর মাধ্যমে করোনা কন্টাক্টে আসা মানুষদের শনাক্ত করা এবং আক্রান্তদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে কেরালা পৃথিবীতে একটা রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেরালার কাছে শেখার আছে অনেক কিছুই। তাদের মডেল নিয়ে কিভাবে বাংলাদেশেও কাজ করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে সরকারকে এবং দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের সমস্যাগুলো নানামুখী তাই এর সমাধানও খুব সহজ হবেনা। বাংলাদেশের মতো একটা দেশের দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন পরিস্থিতি চালিয়ে নেওয়ার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা আসলেই নেই তাই এটা স্বীকার করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মনে রাখতে হবে লকডাউন কোন ওষুধ না বরং একটা ব্যবস্থা। নানান ধরনের সমীকরণ সামনে আসবে এ সময়ে আর সিদ্ধান্তও নিতে হবে মেপে মেপে। এই সময়ে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ সংকটে আছে ফলে বিভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনা কে স্থান দিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই সময়ে এসে আমি ক্ষুদ্র জ্ঞানে একটা প্রস্তাবনা দিতে পারি, যদি সম্ভব হয় আরোও একমাস লকডাউন পরিস্থিতি বহাল রেখে এর মধ্যে কিছু মৌলিক সংস্কার করতে হবে। এবং লকডাউন তুলে নেওয়ার পূর্বেই দেশের প্রত্যেক মানুষকে পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত করতে হবে।
প্রস্তাবনাঃ
১) লকডাউন সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা খাতের সর্বোচ্চ সংস্কার করতে হবে, প্রয়োজনে অস্থায়ী হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। জরুরী ভিত্তিতে মেডিকেল সেচ্ছাসেবী হিসেবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
২) ঘনবসতি অঞ্চল যেমন বস্তি, কলোনি ইত্যাদিকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।
৩) বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তিদের নিয়ে দল-মত নির্বিশেষে একটা জরুরি বোর্ড গঠন করতে হবে এবং দেশব্যাপী কার্যক্রম চালাতে হবে।
৪) এই সময়ে ক্রিয়াশীল সকল সেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং মানুষকে নিয়ে একটা সমন্বিত কার্যক্রম শুরু করতে হবে, এক্ষেত্রে যুক্ত মানুষদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৫) গণ-সচেতনতা এবং সঠিক তথ্য প্রবাহ নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
৬) আপাত কর্মহীন মানুষকে কিভাবে কৃষি শ্রমিক হিসেবে সংকটকালীন সময়ে যুক্ত করা যায় সে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৭) করোনা পরবর্তী সময়ে ক্ষুদ্র আত্মকর্মসংস্থানে যুক্ত মানুষ যারা এই সময়ে কার্যত বেকার এবং মুলধন হারিয়ে ফেলছেন তারা যাতে নিজ পেশায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেন সে ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে এবং এই বিশেষ ঋণের কিস্তি আদায় ঋণ দেওয়ার তিনমাস পর থেকে শুরু করতে হবে।
৮) যে কোন ধরনের দূর্নীতিকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে এবং দ্রুততার সাথে বিচার করে বিচারিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
আমার প্রস্তাবনার সাথে অনেকের দ্বিমত থাকতেই পারে আমি সময় স্বল্পতায় আরো অনেক কিছুই যুক্ত করতে পারিনি। আপনাদের মতামত দিয়ে এই আলোচনাকে আরোও সমৃদ্ধ করবেন বলেই আশা করি।
লিখাঃ০১
করোনায় আমাদের দিনকাল নিয়ে বেশকিছুদিন থেকেই একটা লিখা গুছিয়ে লিখতে চাচ্ছিলাম কিন্তু হয়ে উঠছিল না। সেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার কারণে সময় পাচ্ছিলাম খুবই কম। অল্প কয়েকজন মানুষের উপর অনেক দায়িত্ব ছিল,আছে এবং হয়তো থাকবে। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই যে বিষয়গুলো আমাদের সামনে এসেছে সেটা হল খাদ্য সংকট। সকল শ্রেণীর মানুষই এই আশংকা করে আসছিল। যা এখন দৃশ্যমান। এর বাইরেও কিছু বিষয় নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে, যেমন ধরেন করোনার মোকাবেলা কিভাবে সম্ভব? আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই এ ব্যাপারে একমত, প্রচুর পরীক্ষা করেই কেবল করোনা সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শুধু প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল ব্যাপারটা এমন না বরং অবহেলা এবং অসচেতনতাও ছিল। খাদ্য সংকট যে আসন্ন সে ব্যাপারেও বিভিন্ন রকমের কথা শোনা গেছে দায়িত্বশীল মহলের কাছ থেকে, মাঝে মাঝে এমন মনে হয়েছে তারা নিজেরাই এ ঘটনা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকেফহাল নন। সরকারের একটা সুনির্দিষ্ট অবস্থান পরিষ্কার না করার কারণে জল এখন অনেক ঘোলাটে। এই দূর্যোগ যেহেতু ইতিপূর্বের সকল দূর্যোগ হতে আলাদা ফলে এর সঙ্গে বোঝাপড়ার ধরণটাও সঙ্গত কারণে আলাদা। সারা পৃথিবী জুড়ে যে আতংক ছড়িয়েছে তার সাথে বোঝাপড়া করতে হলে করোনা নিয়ে অন্যান্য দেশগুলীর অভিজ্ঞতাকেও গুরুত্ব দিতে হবে সেই সাথে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রচুর গবেষণা করতে হবে। গবেষণার ব্যাপারে একটা ভ্রান্ত ধারণা আমাদের মধ্যে থেকেই যাচ্ছে, গবেষণা বলতে সবাই বুঝছে করোনার প্রতিষেধক বা ওষুধ নিয়ে গবেষণা কিংবা ভেন্টিলেটর বানানো। এগুলো করোনা রোগীকে বাঁচানোর গবেষণা কিন্তু সামগ্রিক ভাবে পুরো দেশের যে ব্যাপারগুলোর সাথে সমঝোতা করতে হবে তা নিয়েও গবেষণা এবং পূর্বানুমান প্রয়োজন। করোনা শুধু মাত্র একটা মহামারী নয় বরং একটা রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক ঘটনাও। পুরো পৃথিবীর ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার মতো এক যুদ্ধ পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি কোন রাষ্ট্র-সংঘ-রাজনৈতিক দল-সামাজিক সংগঠনের পক্ষে একা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এটা একটা বৈশ্বিক ঘটনা ফলে এর মোকাবেলাও সামগ্রিক একটা ঐক্যের মাধ্যমে করতে হবে।
ফিরি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে, করোনার কারণে যে অর্থনৈতিক ধ্বসের কথা বিভিন্ন মহলের মানুষ বলে আসছিলেন তা কেবল মাত্র চ্যারিটি বা দাতব্য কাজ দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। যে ফাঁক-ফোঁকড় গুলো স্বাধীনতার পর গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কাঠামোতে তৈরি হয়েছিল তা করোনার কারণে এখন বেশ ভাল ভাবেই দৃশ্যমান। এর একটা উদাহারন হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা খাতের ব্যর্থতা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই সময়ে যে ভুমিকা পালন করার কথা ছিল তা কেবল মাত্র সম্ভব ছিল যদি স্বাস্থ্য সেবা খাতকে রাষ্ট্রীয় ভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হতো। আমাদের আমলা-মন্ত্রী-বিত্তশালী অংশ অসুস্থ হলেই বিদেশ ভ্রমণের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে এতোকাল চালিয়ে এসেছেন ফলে এখানে স্বাস্থ্য সেবা খাতে একটা মাৎসোন্যায় অবস্থা প্রকট হয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ চিকিৎসকদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এতোদিনেও স্বাস্থ্যসেবার সাথে যুক্ত নার্স-ক্লিনার-মেডিকেল এসিস্ট্যান্টরা একটা চরম ঝুঁকির মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অন্যান্য দেশে যখন দায়িত্বরত ডাক্তারের পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে তাদের জন্য সেখানে বাংলাদেশে কোন ব্যবস্থাই এখনো দৃশ্যমান নয়। খুব কাছের একজনের কাছ থেকে সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলোর অবস্থা সম্পর্কে আমার একটা ভয়াবহ ধারণাও হয়েছে। যে দায়িত্বের ভার আজকে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের নেওয়ার কথা তাতে দৃশ্যমান হচ্ছে অনেক বেশি অব্যবস্থাপনা! ত্রাণের চাল চুরি এবং উদ্ধারের চিত্র প্রতিদিনের পত্রিকায়। বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন বিভিন্নভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সরকারের স্বদিচ্ছা এবং জনগনের প্রতি দায় থাকলে আমরা হয়তো একটা সমন্বয় করার চেষ্টা বা ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করার প্রয়াস দেখতে পারতাম। সরকার টিভি কিংবা অন্যান্য গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিভিন্ন জনপ্রিয় মুখের সাহায্য নিয়ে সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে পারতেন। বিভিন্ন শ্রমজীবি মানুষ যাদের এই পরিস্থিতিতেও শ্রম দিতে হচ্ছে কোন ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই তাদের যেন কোরবানি করা হয়েছে এমন একটা ভাব সকলের মধ্যেই এমনকি এই অঞ্চলে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করা মানুষের ভেতরেও এই আলাপ সেইভাবে দেখা যায়নি। আমি কিছু আলাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তোলার চেষ্টা করেছি। ক্ষুদ্র আকারে এখানে আবার একই ব্যাপার আমি বলতে চাই,
কাওরান বাজারে আমি কিছু ছবি তুলেছিলাম আমার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে,
এরপরেও আরো ব্যাপার আছে, বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশে খাদ্য সংকট প্রকট হতে পারে কৃষি ব্যবস্থায় কোন আঘাত আসলে আর আমার অনুমান সেই আঘাত এসেই গেছে। সামনের সপ্তাহে হাওড় অঞ্চলের ধান পেকে যাবে ফলে দুই-তিন দিনের মধ্যে ধান কেটে তুলতে না পারলে ধান নষ্ট হবে বিপুল পরিমানে, এর দুই-সপ্তাহের মধ্যেই উত্তরাঞ্চলের ধান কাটার মৌসুম শুরু হবে। গতবছর এমনিতেই আমরা কৃষিভিত্তিক শ্রমজীবীর সংকট লক্ষ করেছি। সেটা করোনার কারণে আরোও প্রকট হবে। এই পরিস্থিতে সেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমেও কৃষকের ধান কেটে দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা যেটা গতবছর করা হয়েছিল ফলে ফলাফল হতে পারে আরোও জটিল। এই সকল সমস্যা আরোও অনেক সমস্যা বা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। সেই জটিলতা গুলোর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অন্যান্য রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি, অপুষ্টি ইত্যাদির মতো সমস্যা দেখা দিতেই পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু সংকট ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান, অনেকের সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে করোনার লক ডাউনের মধ্যেই, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা বাস করছেন এক ধরনের অনিশ্চয়তার জগতে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আছেন সেশন জটের দুশ্চিন্তায়। একটা অব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সব ক্ষেত্রেই। রাষ্ট্র যে ধরনের কাঠামোগত চর্চা করে এসেছে তা ভেঙ্গে পড়বে তাসের ঘরের মতই। ত্রাণের ট্রাক লুটের ঘটনা ভবিষ্যতে আসন্ন চুড়ান্ত সংকটকেই নির্দেশ করে। এই দূর্যোগের সময় কাজ অনেক, রাষ্ট্রীয়-ব্যক্তিগত-সাংগঠনিক ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে সেই সাথে সমন্বয়ের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। করোনা আমাদের নতুন দৃষ্টিতে সব কিছু দেখাচ্ছ-শেখাচ্ছে। এখনই সময় দুর্যোগ মোকাবেলার পাশাপাশি রাষ্ট্রের কল্যাণকর মানবিক রুপান্তর নিয়ে ভাবার এবং গবেষণা করার।
লিখাঃ০২
করোনায় কি পরিস্থিতি হতে পারে? বর্তমানে আমাদের মাথায় যেসব ব্যাপার ঘোরাফেরা করছে সেগুলো হল, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু কিংবা ক্ষুধা এবং দূর্ভিক্ষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার এক প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ লাখ থেকে বিশ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে কিন্তু শুধুমাত্র মৃতের সংখ্যা দিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা পরিমাপ করাটা বোকামি। বাংলাদেশ এমনিতেই অধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রবণ দেশ। সম্প্রতি মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করলেও জিডিপির হিসেবের বাইরেও কিছু তথ্য-উপাত্ত আছে যা আসলে ভিন্ন কথা বলে। আমি আগেও দেশের বস্তি পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু অনেকেই ভাবছেন দেশে বস্তিতে আর কতোজন মানুষ বসবাস করেন। বাংলাদেশে সর্বশেষ সরকারি বস্তি শুমারী হয় ২০১৪ সালে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই শুমারী থেকে জানা যায় ২০১৪ সালে দেশে মোট বস্তি ছিল ১৩৯৯৪ টি যার মোট জনসংখ্যা ২২ লাখ ৩২ হাজার জন। বিবিএস এর এই তথ্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। ২০১৪ সালে করা বস্তি শুমারী থেকে জানা যায় ১৯৯৭ সালের বস্তি শুমারীর তুলনায় ১৭ বছরে বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় চারগুণ। ২০২০ সালে এসে আমরা বলতেই পারি এই জনসংখ্যা আরোও বেড়েছে।
২০১৪ সালের বিবিএস এর করা জরিপ থেকে জানা যায় শুধুমাত্র ঢাকাতেই বস্তি আছে,৩৩৯৪ টি। এই বস্তিগুলোতে মোট ঘর আছে ১ লাখ ৭৫ হাজারটি এবং মোট জনসংখ্যার পরিমান ৬ লাখ। ২০১৩ সালে "মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস)" এর তথ্য অনু্যায়ী বস্তিতে বসবাসকারী পরিবার গুলোর প্রায় পচাত্তর শতাংশ একই কক্ষে বসবাস করে।
অন্যদিকে ইউনিসেফের জরিপ অনুযায়ি বস্তিতে বসবাসকারী পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্যা গড়ে ৪.৩ জন। ২০১৯ সালে এসে ইউনিসেফ বলছে, শুধুমাত্র ঢাকাতেই বস্তির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজারে এবং এর মোট জনসংখ্যা প্রায় চল্লিশ লাখ।
কেন আমরা এই পরিসংখ্যান গুলো দেখছি? কারণটা জানতে পারবেন 'কালের কন্ঠে' প্রকাশিত ২১/১১/২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে যেখানে দাবি করা হয়েছে,বস্তির প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ নূন্যতম স্বাস্থ্যসেবা এবং পর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
আমরা বলতেই পারি করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ও এই বস্তিগুলো পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার আওতার বাইরেই থেকে যাবে। আমার নিজের কাজ করার সুবাদে আমি খুবই স্বল্প আকারে একটি জরিপ চালাতে পেরেছিলাম প্রায় ২০ টি পরিবারের উপর। ১০/৪/২০২০ তারিখেই এই ২০টি পরিবারের মধ্যে ১৬ টি পরিবারের ঘরে খাবার ছিলনা এবং তারা সরকারি এবং বেসরকারি কোনও ত্রাণও পাননি। এই ২০ টি পরিবারের প্রত্যেকটিই নিম্ন আয়ের পরিবার এবং করোনায় সাধারণ ছুটি এবং একধরনের লকডাউনের কারণে পরিবারের প্রধানসহ অন্যান্য কর্মজীবি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন। যদি আমরা ইউনিসেফের দেওয়া তথ্যের দিকে তাকাই তবে দেখা যাবে শুধুমাত্র ঢাকার বস্তিতে বসবাসকারী প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বেঁচে আছেন চরম অনিশ্চয়তার ভেতর। বস্তিগুলোর বসবাসের পরিবেশের কারণেই এখানে করোনার প্রাদুর্ভাব হতে পারে মারাত্মক। খুব সঙ্গত কারণেই বস্তিগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা প্রায় অসম্ভব। একই রান্নাঘর, গণ শৌচালয় ও নলকুপের কারণে এখানে মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র ঘরে নিজেকে আটকে রাখার চিন্তাও করা যায় না। এসব কিছুর পরেও বাংলাদেশে এখন বৈশাখ মাস অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল। প্রচন্ড দাবদাহে বস্তির টিনের ঘরগুলো নরকের চেয়েও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই ঘরগুলোতে বসবাসকারী মানুষগুলো বাধ্য হয়েই গাদাগাদি করে থাকে। করোনার দিনগুলোতে বস্তিগুলোয় করোনা আঘাত হানার আগেই আঘাত হেনেছে ক্ষুধা। বস্তির মানুষের মধ্যে করোনা নিয়েও কোন সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ চোখে পড়েনি সরকারি ভাবে। বেসরকারি কিছু জায়গা থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। পরিক্ষা-নিরিক্ষা করতে আগ্রহী নয় বস্তির বেশিরভাগ মানুষ ফলে পরিস্থিতি হতে পারে আরোও ভয়াবহ। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এর মাধ্যমে আক্রান্ত হবে বেশিরভাগ মানুষ পর্যাপ্ত টেস্ট এবং চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়ার কারণে মৃত্যুর হারও হবে বেশি। ক্ষুধা এবং খাদ্যাভাব দেখা দেবে মারাত্মক আকারে। সেচ্ছাসেবী কিংবা দাতব্য প্রতিষ্ঠান গুলোর জন্যেও বস্তিতে কাজ করা হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ অথচ দায়িত্বশীল মহলের কাছ থেকে এখনো কোন কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।
কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতেও লাগতে যাচ্ছে ধাক্কা!
গত তিন-চার বছর থেকে কৃষক তার ধানের পর্যাপ্ত দাম পাচ্ছেন না, গত বছর এর ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখেছি। কৃষি শ্রমিকের সংকটও প্রকট। এবারও আমনের মৌসুমে ধানবীজের দাম কমে যাওয়ায় কৃষক বিপদে পড়েছে। ২০১৮ সালের কৃষিমন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট উৎপাদিত চালের পরিমান প্রায় ৩৩৮.০৪ লক্ষ মেট্রিক টন যার একটা বিরাট অংশ তথা ১৩৬.৫৬ লক্ষ মেট্রিক টন আসে আমন ধান থেকে। বাকিটা উৎপাদিত হয় ইরি এবং বোরো মৌসুমে। এবার করোনার আঘাত আসতে যাচ্ছে বোরো ধান কাটা এবং আমনের উৎপাদনের উপর। আগামী কাল থেকে হাওর অঞ্চলে এবংদুই সপ্তাহের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়ে যাবে। সঠিক সময়ে ধান কেটে ঘরে তুলতে না পারলে অর্থনৈতিক হুমকির মধ্যে পড়বে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০.৬ শতাংশ মানুষ যারা মূলত কৃষি নির্ভর জীবন যাপন করে। বনিকবার্তা তার প্রতিবেদনে বলছে, প্রায় ৬৬ হাজার অভিবাসি শ্রমিক লাগবে এবার হাওড় অঞ্চলে,মোট শ্রমিকের ১৮ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে এবার। পাহাড়ি ঢল এবং বন্যার সম্ভাবনা থাকায় ধান কেটে ঘরে তুলতে হবে দ্রুত। এছাড়াও আমনের উৎপাদনে করোনার ধাক্কা লাগলে দেশ একটা দীর্ঘ মেয়াদি খাদ্য সংকটে পড়তে পারে। গত তিন-চার বছরে এমনিতেই কৃষকের মাথাপিছু ঋণের পরিমান বেড়েছে তার উপর এ ধরনের ঘটনা মারাত্মক হতে পারে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে পরিস্থিতি আরোও জটিল হয়ে উঠবে। সরকারের পক্ষথেকে ৫% সুদে কৃষককে ঋণ দেওয়ার ঘোষনা আসলেও খুব আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এই ঋণের ঠিক কতটুকু প্রকৃত কৃষকের কাছে পৌছুবে তা বলা মুশকিল। এ সময়ে প্রকৃত কৃষকদের বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ কিছুটা কাজ করত। কৃষি অর্থনীতি ঠিক রাখতে যে দীর্ঘ মেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল কৃষক যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সেটা নিশ্চিত করা। এর পাশাপাশি নিরবিচ্ছিন্ন উৎপাদন যাতে নিশ্চিত হয় সেদিকে নজর দেওয়া। নয়তো ৫% সুদে দেওয়া ঋণ কৃষকের মাথায় ঋণের বোঝা বাড়া ছাড়া আর কোন লাভ হবে না।
ধাক্কা লাগবে শ্রমশক্তি রপ্তানিতেও।
২০২০ সালের প্রথম ১৫ দিনে প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে পাঠিয়েছেন ৯০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের রেকর্ড পরিমান রেমিট্যান্স। কিন্তু করোনার পৃথিবীব্যাপি আগ্রাসনে বেকার হয়ে পড়েছেন বেশিরভাগ প্রবাসী শ্রমিক। বিদেশে কর্মরত আছেন দেশের প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক। যার একটা বিরাট অংশ মধ্যপ্রাচ্যে এবং পশ্চিমা দেশগুলায়। ফলে করোনার কারণে স্তিমিত হয়ে গেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স এর অবদান ৫.৪৭ শতাংশ। এই পরিমান আরো কমলে দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। করোনা পরবর্তী পৃথিবী হয়তো নতুন কিছু সমস্যার সম্মুখীন হবে, বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শ্রমশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে একটা বড়সড় বাধা আসতে পারে। এই ব্যাপারে এখনই ভাবতে হবে নয়তো পরিস্থিতির মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
২০/০১/২০১৯ তারিখে প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ২ কোটি ৪১ লাখ হতদরিদ্র মানুষ রয়েছেন যাদের দৈনিক আয় ৬১ টাকা ৬০ পয়সার নিচে। এই মানুষগুলোর জীবন করোনা কালে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে। খাদ্য ও চিকিৎসার কোন নিশ্চয়তা নেই। নেই সরকারি কিংবা বেসরকারি দীর্ঘ মেয়াদি কোন উদ্যোগ। কিন্তু দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। পুরো ব্যবস্থাটাই দাঁড়িয়ে আছে এই হতদরিদ্র মানুষদের কাঁধে। ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় যে সংকট এবং অব্যস্থাপনা দেখা দিয়েছে তার আশু সমাধান প্রয়োজন নাহলে এপ্রিলের শেষ থেকে অবস্থা আরোও জটিল হয়ে যাবে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এ সময়টাতে করোনার প্রকোপ বাংলাদেশে সর্বোচ্চ হতে পারে।
দেশের গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত আছেন প্রায় ৪৪ লাখ মানুষ। গত ২৬ শে মার্চ থেকে শুরু হওয়া সাধারণ ছুটির কারণে এই ৪৪ লাখ মানুষ কার্যত কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। গার্মেন্টস গুলোতে শুরু হয়েছে শ্রমিক ছাঁটাই এবং লে অফ। সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণার পরেও সারাদেশ থেকে শ্রমিকদের হাঁটিয়ে তাদের কর্মস্থলে আনার সময়েও সরকারের ভুমিকা ছিল নিরব অথচ এই মানুষগুলোই জিডিপিতে অবদান রাখেন সবচেয়ে বেশি।
করোনার কারণে পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তার ভেতর টিকে থাকতে গেলে এই সময়ে এরকম হাজারটা সমস্যাকে সাহস ও স্বদিচ্ছা নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে সরকারের। সিন্ডিকেট ব্যবসার মাধ্যমে এবং সামনে রোজায় মানুষকে জিম্মি করে কেউ যাতে ফায়দা লুটতে না পারে তার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি প্রয়োজন নয়তো করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি হবে চরম মাত্রায় ভয়াবহ। দেশ আবার একটা দীর্ঘকালিন সময়ের জন্য পিছিয়ে পড়বে। এই সময়ে দূর্নীতি রোধ করে সকল কার্যক্রম পরিচালনাই সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
খসড়া প্রস্তাবনাঃ
আমার এর আগের দুটি লিখায় আমি দেখাতে চেয়েছি বাংলাদেশের অর্থনীতি সহ সামগ্রিক পরিস্থিতি কোন কোন সমস্যায় পড়তে পারে। লিখা দুটি পরে অনেকেই আমার কাছে সমাধান জানতে চেয়েছেন। আসলে এই ধরনের একটা সম্পূর্ণ নতুন সমস্যার হুট করে সমাধান দেওয়া আদৌ সম্ভব নয় বরং কিছু সম্ভাবনার কথা বলা যেতে পারে। অনেকেই করোনা দূর্যোগের সমাধান হিসেবে লকডাউন কে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে লকডাউনের সাথে জড়িত অন্যান্য ঘটনাগুলো ছাড়া শুধু লকডাউনের মাধ্যমে এর মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। বরং কিছুটা হাস্যকর ব্যাপার। গত কিছুদিন ধরেই ভারতের "কেরালা" রাজ্য ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। কেরালা লকডাউনের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য নিশ্চিত করতে পেরেছিল জন্যেই তাদের এই সামগ্রিক সাফল্য। এন্টিবডি টেস্ট করার মাধ্যমে করোনা আক্রান্তদের শনাক্ত করা, ডিজিটাল সার্ভিল্যান্স এর মাধ্যমে করোনা কন্টাক্টে আসা মানুষদের শনাক্ত করা এবং আক্রান্তদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে কেরালা পৃথিবীতে একটা রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেরালার কাছে শেখার আছে অনেক কিছুই। তাদের মডেল নিয়ে কিভাবে বাংলাদেশেও কাজ করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে সরকারকে এবং দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের সমস্যাগুলো নানামুখী তাই এর সমাধানও খুব সহজ হবেনা। বাংলাদেশের মতো একটা দেশের দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন পরিস্থিতি চালিয়ে নেওয়ার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা আসলেই নেই তাই এটা স্বীকার করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মনে রাখতে হবে লকডাউন কোন ওষুধ না বরং একটা ব্যবস্থা। নানান ধরনের সমীকরণ সামনে আসবে এ সময়ে আর সিদ্ধান্তও নিতে হবে মেপে মেপে। এই সময়ে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ সংকটে আছে ফলে বিভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনা কে স্থান দিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই সময়ে এসে আমি ক্ষুদ্র জ্ঞানে একটা প্রস্তাবনা দিতে পারি, যদি সম্ভব হয় আরোও একমাস লকডাউন পরিস্থিতি বহাল রেখে এর মধ্যে কিছু মৌলিক সংস্কার করতে হবে। এবং লকডাউন তুলে নেওয়ার পূর্বেই দেশের প্রত্যেক মানুষকে পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত করতে হবে।
প্রস্তাবনাঃ
১) লকডাউন সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা খাতের সর্বোচ্চ সংস্কার করতে হবে, প্রয়োজনে অস্থায়ী হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। জরুরী ভিত্তিতে মেডিকেল সেচ্ছাসেবী হিসেবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
২) ঘনবসতি অঞ্চল যেমন বস্তি, কলোনি ইত্যাদিকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।
৩) বিশেষজ্ঞ ব্যাক্তিদের নিয়ে দল-মত নির্বিশেষে একটা জরুরি বোর্ড গঠন করতে হবে এবং দেশব্যাপী কার্যক্রম চালাতে হবে।
৪) এই সময়ে ক্রিয়াশীল সকল সেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং মানুষকে নিয়ে একটা সমন্বিত কার্যক্রম শুরু করতে হবে, এক্ষেত্রে যুক্ত মানুষদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৫) গণ-সচেতনতা এবং সঠিক তথ্য প্রবাহ নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
৬) আপাত কর্মহীন মানুষকে কিভাবে কৃষি শ্রমিক হিসেবে সংকটকালীন সময়ে যুক্ত করা যায় সে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৭) করোনা পরবর্তী সময়ে ক্ষুদ্র আত্মকর্মসংস্থানে যুক্ত মানুষ যারা এই সময়ে কার্যত বেকার এবং মুলধন হারিয়ে ফেলছেন তারা যাতে নিজ পেশায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেন সে ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে এবং এই বিশেষ ঋণের কিস্তি আদায় ঋণ দেওয়ার তিনমাস পর থেকে শুরু করতে হবে।
৮) যে কোন ধরনের দূর্নীতিকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে এবং দ্রুততার সাথে বিচার করে বিচারিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
আমার প্রস্তাবনার সাথে অনেকের দ্বিমত থাকতেই পারে আমি সময় স্বল্পতায় আরো অনেক কিছুই যুক্ত করতে পারিনি। আপনাদের মতামত দিয়ে এই আলোচনাকে আরোও সমৃদ্ধ করবেন বলেই আশা করি।
জাফর মুহাম্মদ
চিন্তক, সিভিএন



Post a Comment