আমি কখনোই বাংলায় কথা বলতে চাইনি!

শিরোনাম দেখে অনেকেই হয়তো আমাকে বাঙালী হিসেবেই খারিজ করে দেবেন কিন্তু ব্যাপারটা আসলে এমনই, আমি কখনোই বাংলায় কথা বলতে চাইনি। যেহেতু আমার বাড়ি এবং বেড়ে ওঠা পঞ্চগড়ে এবং পঞ্চগড়ের একটা নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা আছে সেজন্য প্রমিত বাংলা ভাষা আমার মাতৃভাষা নয় বরং অনেকটা বিদেশী ভাষার মতই। খানিকটা বোধ-বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমাকে শিখতে হয়েছে প্রমিত বাংলা ভাষা। প্রমিত বাংলার আগ্রাসনে আঞ্চলিক ভাষাগুলো বিলুপ্তির পথে। এর যন্ত্রণাটা হয়তো বলে বোঝানো সম্ভব নয়, জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে, সভ্য/ভদ্র হবার জন্য ইংরেজি শেখা আর প্রমিত বাংলা শেখা প্রায় একই রকমের ঘটনা, এজন্যই আমি বলতে চাই প্রমিত বাংলা রাষ্ট্রভাষা হতে পারে, মাতৃভাষা নয়। এখন প্রশ্ন হল, কেন এই বোধটুকু প্রয়োজন? প্রথমত যেকোন আগ্রাসনই প্রাকৃতিক বিকাশকে বাধা গ্রস্থ করে, দ্বিতীয়ত এই আগ্রাসনের কারণেই সাংস্কৃতিক ভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে সমাজ। 

আসুন একটু দেখে আসি প্রমিত বাংলার সাথে পঞ্চগড়ের আঞ্চলিক বাংলার শব্দগত পার্থক্য,

প্রমিত বাংলা পঞ্চগড়ের আঞ্চলিক বাংলা 
 আসছিস?  অইচ্চি?
 গিয়েছিলাম  গেছনু
 খেয়েছিলাম খাইসনু
 করতে হবে করবা হোবে
 যেতে হবে যাবা হবে
 কোথায় গেল? কুন্তি গেল্
 দোকান দকান
 অনেক গুলো ভেল্লা
 আসছেন? অইচ্চেন?
 কোথায় গেলা কেত গেলো
 মেয়ে(বয়সে ছোট) মাইডি
 ছেলে ( বয়সে ছোট) বাউডি
 অনেক দূর ভেলে দূর
 উঠান এঙনা
 ঝাড়ু বাড়ু(হ)ন
 ভাসুর ভইজ্যা
 ভাসুরের বৌ ভৌশানি
 বলতে হবে কহিবা হোবে
 কেন ? কিতায়?
 কোথায়? কুন্ঠে?
 আগুন অগিন
 বোকা ভ্যালটেঙ্গা
 হয়েছে হইচ্যা 
 চেয়েছিলচাহিচিল 
 গেলামগেনু 
 গাভীগাই 

একজন মানুষ মাল্টি লিঙ্গুয়াল বা একাধিক ভাষায় দক্ষ হতেই পারে কিন্তু এর মানে এই নয় যে  তার মাতৃভাষা বদলে যাবে, এই বদলে দেওয়ার মধ্যে আছে আগ্রাসনের ছাপ, যে আগ্রাসন চালিয়েছিল সকল ঔপনিবেশিক শক্তি , আজ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামে তাই চলছে, ম্রো, তঞ্চঙ্গা, সাঁওতাল , মণিপুরি, গাড়ো সংস্কৃতির মানুষের সাথে আমার যন্ত্রণাটা আলাদা নয়, তাদের সংস্কৃতি যেভাবে বৈশ্বিক এবং দেশীয় আগ্রাসনের স্বীকার হয়েছে আমার সংস্কৃতিও একই আগ্রাসনের স্বীকার, এখন পঞ্চগড়ে বিয়েতে কেউ আর 'হেড়ুয়া' দিয়ে ওঠে না, ধান কাটায়- ঘর বাঁধায় কেউ দেয়না 'হাউলী' । আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির খবর এখন আমরাই জানি না, 'হাউলি' হচ্ছে এক ধরনের সেচ্ছাশ্রম, কারো ধান কাটার শ্রমিকের কিংবা কোন কাজের শ্রমিকের প্রয়োজন হলে পরিচিতরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে দিতো এবং যার কাজ করে দিতো যে দাবাত/জিয়াফত/দাওয়াত খাওয়াতো। সেই দাওয়াতের মেনুও যেন নির্ধারিত মুরগীর তরকারি সাথে শাকের ঝোল বা ডাল। খাবার-দাবারেও ছিল বৈচিত্র, পাট শাকের ঝোল, নাপা/লাফা শাকের ঝোল, প্যালকা, টমেটোর খাটা একই সাথে স্বাস্থ্যকর এবং উপাদেয়। 

এখানে প্রমিত বাংলায় ভাল করে কথা না বলতে পারলে হেয় করার যে কালচার/সংস্কৃতি দাঁড়িয়েছে তা আসলে মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করার কালচার, মানুষকে শ্রদ্ধা না করার কালচার। প্রমিত বাংলা আসলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা, দেশের মধ্যে সকল অংশের মানুষের মধ্য সাধারণ যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম কিন্তু এটাকেই যদি বাঙালী সংস্কৃতি হিসেবে ধরা হয় তাহলে অনেকেই সেই তথাকথিত সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করেন, প্রমিত বাংলার সংস্কৃতি মূলত কৃত্রিম সংস্কৃতি আর সেজন্যই একে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় এবং প্রয়োজনে জুলুম করতে হয়। বাংলা, হিন্দী, উর্দু , ইংরেজি যাই বলুননা কেন, আমার ভাষা হিসেবে শ্রদ্ধা আছে কিন্তু তার মানে এই না কাউকে আমি আমার ভাষাকে ছোট করে দেখলে ছেড়ে দেবো। বইগুলোতে আজীবন পড়ানো হল বাংলা আমার মাতৃভাষা কিন্তু আমার মনে হয় না এখনো বাংলা প্রকৃতই এদেশের অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা হয়ে উঠেছে, ভাষা একটা হাজার বছরের প্রবাহ , এর গতিপ্রকৃতি বদলানোর চেষ্টা মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে।  
উর্দু - হিন্দি সহ অন্য রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ভাষায় কথা বলা মানুষও আমাদের দেশে আছেন এবং তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন তাদেরকে আলাদা চোখে দেখার মধ্যে দৃষ্টি ভঙ্গির সংকীর্ণতাই প্রকাশ পায়।

কোন ভাষাকেই অন্য ভাষা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ করে দেখাটা আমাদের উপনিবেশিক চিন্তা কাঠামোর ফলাফল। আঞ্চলিক অপেক্ষা প্রমিত বাংলা ভাল, বাংলা অপেক্ষা ইংরেজি ভাল এই চিন্তা থেকে যতোদ্রুত বের হওয়া সম্ভব ততোই মঙ্গল।


 









কোন মন্তব্য নেই