মওলানা ভাসানী (মজলুম জননেতা,The great red mawlana, Prophet of violence)

১৮৮০ খ্রীস্টাব্দ : ১২ ডিসেম্বর জন্ম। সিরাজগঞ্জ শহরের অদুরে সয়া ধানগড়া গ্রামে। পিতা আলহাজ শরাফত আলী খান। মাতা মজিরন বিবি। শৈশব- কৈশোরের সন্ধিক্ষনে পিতৃহারা হন। তখনই উপমহাদেশের প্রখ্যাত সূফী সৈয়দ নাসির উদ্দিন আহমদ বোগদাদীর (রঃ আঃ ) দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যৌবনের উন্মেষে চিরদিনের জন্য গৃহত্যাগী হন। সূফীর সহচর্যে ময়মনসিংহ শহরের উপকন্ঠে বাদে কলপা গ্রামে তিন বৎসর কাটিয়ে তাঁরই সাথে আসামের ধুবরী মহকুমার জলেশ্বর গ্রামে বসবাস করেন। সৈয়দ নাসির উদ্দিন আহমদ বোগদাদীর (রহঃ) তত্ত্বাবধানে কালক্রমে তাসাউফের সাধনা সমাপ্ত করেন। একই সাথে চলে কিতাবী শিক্ষা গ্রহন।
 মওলানা ভাসানীর মানসগঠনে সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছেন তি সুফি বুজুর্গ যার নাম সৈয়দ নাসির উদ্দিন আহমদ। তিনি বাগদাদ হতে এসেছিলেন। মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭-৫৮) পরবর্তীতে কোলকাতায় বসবাস করছিলেন হেকিমি চিকিৎসক হিসেবে। মওলানা ভাসানীর পিতা আলহাজ শরাফত আলী খানের সিরাজগঞ্জ শহরে ছোট্ট একটি জুতার দোকান ছিল যার মালামাল ক্রয় করতে তাঁকে কোলকাতায় যেতে হত এবং ঐ সুবাদে সৈয়দ বুজুর্গের সাথে তাঁর পরিচয় ও বন্ধুত্ব জমে ওঠে। বন্ধুর বাড়ী সিরাজগঞ্জে তিনি এসেছিলেন এক সুদখোর মহাজনের পরিত্যক্ত বাড়িতে ইন্দিরা ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করতে। তখন দেখেন শিশু আবদুল হামিদ খানকে এবং কিশোর বয়সের সর্বহারা ঐ ইয়াতিমকে আপন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ইতোমধ্যে সৈয়দ বুজুর্গ আসামে বসবাস করতে শুরু করেন। গ্রামের নাম জলেশ্বর। থানা ও জেলা ধুবরী। তরুণ বয়স হতে মোঃ আবদুল হামিদ খান সৈয়দ নাসির উদ্দীন আহমদের চোখে চোখে লালিতপালিত হয়েছেন। তিনি তাঁকে জীবন-বিচ্ছিন্ন লালন-পালন করেননি। আসামের বন-জঙ্গলে কঠোর পরিশ্রমের জীবন, চরম দুঃসাহসিকতার জীবন- সেদিকেই তাঁকে আবদ্ধ করেছেন। জীবনটা ছিল উৎপাদনের জন্য সংগ্রাম-মুখর। জঙ্গল কাটো, হিংস্র পশুর মুখোমুখি হও, বিষধর সাপকেও বশ কর; জঙ্গলের জোঁক, মায় মশার ঝাঁককেও কাবু করে কাজ কর। সাফ-সুতরো হলে লাঙল চালাও, ফসল ফলাও। তরুণ আবদুল হামিদ সংগ্রাম-নির্ভর উৎপাদনমুখীন জীবন গড়ার শিক্ষা পেলেন। 
সুফি বুজুর্গ এতটুকুতেই তাঁকে আটকে রাখেননি। প্রাচীনকালে তপোবনের জীবনে যেভাবে গুরু-কেন্দ্রিক শিক্ষা দেয়া হত, তিনি তাঁকে সেভাবে বিকশিত করে তুলেন। নিজেই তাঁকে আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষা শিক্ষা দিলেন। চিকিৎসাবিদ্যা, তর্কশাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব, দর্শন সুফি বুজুর্গের যা জানা এবং যেভাবে জানা সবই আবদুল হামিদকে রপ্ত করালেন। এভাবে আবদুল হামিদ যখন প্রস্তুত, তখন তাঁকে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে দেওবন্দ পাঠালেন। দেওবন্দে পাঠালেন প্রথানুযায়ী ছাত্র হবার জন্যে নয়, পাঠক্রম অনুযায়ী সনদ অর্জনের জন্যে নয়- পাঠালেন দু’জন ওস্তাদের সাহচর্যে থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারতীয় দার্শনিক-তাত্ত্বিক শাহ ওয়ালিউল্লাহর গ্রন্থাবলী পড়তে ও আত্মস্থ করতে। শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান ও সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানি (উভয়ই প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ বিরোধী রেশমি রুমাল আন্দোলনের নেতা ও ভূমধ্যসাগরের মাল্টা দ্বীপে নির্বাসিত) ১৯১২ পর্যন্ত অনুসন্ধানী আবদুল হামিদ খানকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ পড়ালেন। এখানেই পরবর্তীকালের মওলানা ভাসানী শিখলেন- পৃথিবী জুড়ে যুগ যুগ ব্যাপী চলছে জালিম ও মজলুমের লড়াই। মওলানা ভাসানী আহরণ করলেন শাস ওয়ালিউল্লাহর নীতিবাক্য, আরবি ভাষায়- ফুক্কা কুল্লে নেজামিন, বাংলায়- নির্মূল কর বিদ্যমান সব ব্যবস্থা (সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা জালিম প্রতিষ্ঠিত করে)। এই বিপ্লবী নীতিবাক্য মওলানা ভাসানীকে সমগ্র জীবনব্যাপী তাড়া করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। দেওবন্দ পরবর্তী জীবনটা তিনি শুরু করেছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোখলেস, মানিকগঞ্জের আবদুল গফুর তাঁকে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র ধারায় সংযুক্ত করেন। তাঁদের গ্রুপে আরও যাঁরা ছিলেন ভগবৎ চন্দ্র দাস, কৃষ্ণসুন্দর দাস, ওয়াসিমউদ্দিন মিয়া, চুন্নু মিয়া অন্যতম।


‘রব্বানীগণ কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আল্লাহ্‌ নিজেই বলেছেন: তোমরা রব্বানী হয়ে যাও। আল্লাহ্ আরো বলেছেন: আমার রঙে রঞ্জিত হও। সৃষ্টির লালন-পালনে তিনি কি কখনো সাম্প্রদায়িক? রাব্বুল আলামীন যেমন নন, তেমনি তাঁর পালনবাদের অনুসারিগণও সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না।’-মওলানা ভাসানী।

ভাসানীর জীবন যাপনের মধ্যেই আসলে ছিল একধরনের সরলতা,আশ্চর্য  ভাবে মানুষকে টানতেন তিনি। কখনো হয়তো জমিদার মহাজনের বাড়িতে আগুন দিয়ে মহাজনের সুদের কাগজ পুড়িয়ে দিয়েছেন আপামর সাধারণ কৃষক ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে আপন করে নিয়েছে তাকে। বন্যায়-জলোচ্ছাসে ছুটে গিয়েছেন  দূর্গম পীড়িত এলাকায়।ধুবরির চর,আসাম,পাবনা,সিরাজগঞ্জ,টাঙ্গাইল কিংবা অন্য কোথাও যেখানে মানুষ  অত্যাচারিত-নিপিড়ীত  কিংবা কষ্টে থেকেছে ভাসানী ছুটে গেছে,, সৃষ্টির সেবাকেই আমল হিসেবে জ্ঞান করেছেন।  শুধু এই উপমহাদেশের শান্তি নিয়ে ভাসানী চিন্তিত ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক, তিনি ভেবেছেন এই পুরো পৃথিবীর মানুষের শান্তি নিয়ে। এই বার্তা  নিয়ে ছুটেছে,লড়াই করেছেন, বক্তৃতা করেছে  যা কিছু আঁকড়ে ধরার তা ধরেছেন।

 “আজ সারা বিশ্বের মানুষ শান্তি শান্তি বলিয়া চিৎকার করিতেছে। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠা হইতেছে না কেন? একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাইবে যে, এখানেও নফসানিয়াত সুকৌশলে কাজ করিয়া যাইতেছে। আমেরিকা চায় আমেরিকার মত করিয়া শান্তি। অপর পক্ষ রাশিয়া চায় রুশদের দৃষ্টিকোণ হইতে। অর্থাৎ ব্যাক্তিগত স্বার্থ দেশগত স্বার্থে রুপান্তরিত হইয়া শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বাধার সৃষ্টি করিতেছে। আমরা যদি ভুলিয়া যাইতে পারতাম ব্যাক্তিগত অথবা দেশগত স্বার্থকে, আমরা যদি গ্রহণ করিতে পারতাম পালনবাদের স্বভাব সুন্দর নীতি, তাহা হইলে শান্তি হয়ত সুদূর পরাহত হইত না।” -মওলানা ভাসানী


বঙ্গোপসাগরে মহাসাইক্লোন হয়েছিল ১৯৭০ সনের ১২ নভেম্বর। তখন রমজান মাস ছিল। ১০ থেকে ১৫ লক্ষ মানুষের লাশ বঙ্গোপসাগরে ভেসে গিয়েছিল। পাকিস্তান সরকার কোন ব্যবস্থাই নেয় নাই তাঁদের জন্য। মওলানা ভাসানী গায়েবিনী জানাজা পড়ান। এলাকাগুলো সফর করে ২২ রমজানের রোজা মুখে, ভাসানী পল্টনের জনসভায় ভাষণ দেন ২৩শে নভেম্বর। সেই সভা শেষে সমাপ্তি টানেন একটি শ্লোগান বলে যা পুরো বক্তৃতার মূল কথা ছিল– “স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান : জিন্দাবাদ”। 
সেই ভাষণের পটভূমিতে কবি শামসুর রহমান ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতাটা লেখেন– 


সফেদ পাঞ্জাবী

শামসুর রহমান

শিল্পী,কবি, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক,
খদ্দের, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবিকা,
নিপুণ ক্যামেরাম্যান, অধ্যাপক, গোয়েন্দা, কেরানী,
সবাই এলেন ছুটে পল্টনের মাঠে, শুনবেন
দুর্গত এলাকা প্রত্যাগত বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী
কি বলেন । রৌদ্রালোকে দাঁড়ালেন তিনি, দৃঢ়, ঋজু,
যেন মহাপ্লাবনের পর নূহের গভীর মুখ
সহযাত্রীদের মাঝে ভেসে ওঠে, কাশফুল-দাঁড়ি
উত্তুরে হাওয়ায় ওড়ে । বুক তাঁর বিচূর্ণিত দক্ষিণ বাংলার
শবাকীর্ণ হুহু উপকূল, চক্ষুদ্বয় সংহারের
দৃশ্যাবলীময়, শোনালেন কিছু কথা, যেন নেতা
নন, অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার । জনসমাবেশে
সখেদে দিলেন ছুড়ে সারা খাঁ খাঁ দক্ষিণ বাংলাকে ।
সবাই দেখলো চেনা পল্টন নিমিষে অতিশয়
কর্দমাক্ত হয়ে যায়; ঝুলছে সবার কাঁধে লাশ
আমরা সবাই লাশ, বুঝি-বা অত্যন্ত রাগী কোনো
ভৌতিক কৃষক নিজে সাধের আপনকার ক্ষেত
চকিতে করেছে ধ্বংস, পড়ে আছে নষ্ট শস্যকণা ।
ঝাঁকা মুটে, ভিখারী, শ্রমিক, ছাত্র, সমাজসেবিকা,
শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবী, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক,
নিপুণ ক্যামেরাম্যান, ফিরিঅলা, গোয়েন্দা, কেরানী
সমস্ত দোকানপাট, প্রেক্ষাগৃহ, ট্রাফিক পুলিশ
ধাবমান রিক্সা, ট্যাক্সি, অতিকায় ডবল ডেকার
কোমল ভ্যানিটি ব্যাগ আর ঐতিহাসিক কামান
প্যান্ডেল, টেলিভিশন, ল্যাম্পপোস্ট, রেস্তোরা, দপ্তর
যাচ্ছে ভেসে; যাচ্ছে ভেসে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগরে
হায়! আজ একি মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী ।
বল্লমের মত ঝলসে ওঠে তাঁর হাত বারবার
অতিদ্রুত স্ফীত হয়; স্ফীত হয় মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবী
যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবী দিয়ে সব
বিক্ষিপ্ত বেআব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান ।

জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনপঞ্জির (১৮৮০- ১৯৭৬) গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী:

১৮৮০ খ্রীস্টাব্দ : ১২ ডিসেম্বর জন্ম।
১৯০৩ হতে ১৯০৫: সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে যোগদান। বিভিন্ন কর্মকান্ডে যোগদান করার পর সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন পরিত্যাগ।
১৯০৭ হতে ১৯০৯: সৈয়দ নাসিরউদ্দিন আহমদ বোগদারীর (রহঃ আঃ) নির্দেশে উত্তর ভারতের দেত্তবন্দ দারুল উলুম- এ অবস্থান করেন। সেখানে শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান ও শায়খুল ইসলাম সৈয়দ হেসোইন আহমদ মাদানীর প্রত্যক্ষ সাহচার্যে শিক্ষা লাভ করেন। এদের সাহচর্যেই রবুবিয়াতের রাজনৈতিক দর্শন শিক্ষা লাভ হয়।
১৯১১: মওলানা মোহাম্মদ আলীর সান্নিধ্যে ও নেতৃত্বে প্রথম প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যোগদান। (শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ তাঁর নামে ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।)
কংগ্রেসে যোগদান।
১৯১৭-১৮: প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে তুরস্কের সাহায্যে ভারতবর্ষ স্বাধীন করার পরিকল্পনা অর্থাৎ ইতিহাস খ্যাত রেশমী রুমাল আন্দোলনে যোগদান এবং এতদউদ্দেশ্যে হেজাজে (বর্তমান সৌদি আরব) গমন ও প্রথম হজ সমাপন। আন্দোলনের নেতাদের মাল্টায় নির্বাসন। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
১৯১৯: প্রথম কারাবরণ। দেশবন্দু চিত্তরঞ্জন দাসের সাহচর্য লাভ যা ১৯২৫ সন পর্যন্ত অব্যাহত।
১৯২০ হতে ১৯২৫: দেশবন্ধুর স্বরাজ আন্দেলন ও বেঙ্গল প্যাক্টের সাথে একাত্ব হয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যোগদান। জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি থানার বীরনগর গ্রামে বিবাহ (স্ত্রী আলেমা খাতুন ভাসানী)
১৯২১ হতে ১৯২৩: খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান এবং কারাবরণ। উত্তর বঙ্গের প্রলয়য়ঙ্করী বন্যায় ত্রাণ কার্যে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও নেতাজী সুভাস বসুর সাথে যোগদান। সকলের দুষ্টি আকর্ষণ।
১৯২৪: কলকাতা কেন্দ্রীক রাজনৈতিক জীবনকে প্রাধান্যে না রেখে বিশেষ করে ১৯১৯ সন হতে আসামের ও পূর্ব বাংলার গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে কৃষক মজুরদের সুসংগঠিত করার ধারাবাহিক কর্মপ্রয়াস বাস্ত বায়নের পর আসামের ভাসান চরে ঐতিহাসিক কৃষক- প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠান। পারিবারিক নাম “মোঃ আবদুল হামিদ খান” এর সাথে “ভাসানী” উপাধি প্রাপ্তির যোগসূত্র এখানেই। তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এ সম্মেলন বাংলা- আসামের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে।
১৯২৫ হতে ১৯২৭: আসামে ও পূর্ব বাংলায় কৃষক- মজুরদের স্বার্থে সংগঠন গড়ে তোলায় এবং জমিদার ও সুদখোর মহাজন বিরোধী আন্দোলন তীব্রতর করনে আত্বনিয়োগ।
১৯২৮: কলকাতায় অনুষ্ঠিত খিলাফত সম্মেলনে যোগদান।
১৯২৯: আসামের ভাসান চরে দ্বিতীয় বারের কৃষক- প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত। সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দের যোগদান। আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ সম্মেলন পরবর্তীতে- প্রজা-স্বার্থে আইন প্রনয়ণে প্রভাব সৃষ্টি করে।
১৯৩0: রাভী নদীর তীরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সম্মেলনে যোগদান ও গুরুতর মতবিরোধ।
১৯৩১: প্রলয়ঙ্করী বন্যায় আক্রান্তদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে আসাম হতে টাঙ্গাইলে আগমন। খোশনদপুর তথা সন্তোষের ওয়াকফ সম্পত্তির জবর দখলকারী মহারাজার সাথে বিরোধ ও বিবাদ।
১৯৩২: তদান্তীন ময়মনসিংহ জেলা হতে বহিস্কৃত। ডিসেম্ভর সিরাজগঞ্জের কাওয়াখোলা ময়দানে তিনদিন ব্যাপী কৃষক- প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠান। অতঃপর জন্মভূমি পাবনা জেলা হতে বহিস্কৃত।
১৯৩৩ হতে ১৯৩৫: ১৯৩৩ এ আসামের ভাসান চরে এবং ১৯৩৪ সনে টাঙ্গাইলের চারাবাড়ীতে কৃষক সম্মেলন। আসাম ও পূর্ব বাংলায় সামন্ত প্রথা, সামন্ত শোষন বিরোধী আন্দোলন জোরদার করণ। উত্তর ভারতের আমরুহাতে অনুষ্ঠিত (১৯৩৫) সর্বভারতীয় বিপ্লবী চিন্তাধারার আলেমদের সম্মেলনে যোগদান এবং আলামা আজাদ সোবহানীর সাহচর্য লাভ।
১৯৩৬: আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান। আসামের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতির পদ বরণ। আলামা আজাদ সোবহানীর সাথে মিসরে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন।
১৯৩৭: আসামে কুখ্যাত লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন তীব্রতর করণ। আসামের মজলুম মানুষের এ জীবনমরণ আন্দোলনে অব্যাহত গতিতে নেতৃত্ব দান। আসাম প্রাদেশিক পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য নির্বাচিত যা ১৯৪৭ পর্যন্ত বহাল।
১৯৩৮: আসামের বড়পেটায় এবং মঙ্গলদৈ-এ কৃষক সম্মেলন। পূর্ব বাংলার গাইবান্ধায় কৃষক সম্মেলন।
১৯৩৯: জনগণের পার্টিতে পরিণত করতে মুসলিম লীগের কর্মকান্ড জোরদার করণ।
১৯৪০: মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে প্রাদেশিক সভাপতি (আসাম মুসলিম লীগ) হিসাবে যোগদান। লাহোর প্রস্তাবের সাবজেক্ট কমিটির সদস্য হিসাবে পাকিস্তান প্রস্তাব প্রণয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন। দ্বিতীয় বারের মত হজ্ব সমাপন।
১৯৪১: যুগপৎ লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে পাকিস্তান আন্দোলন পরিচালনা (১৯৪৭ পর্যন্ত)।
১৯৪৪: বড়পেটায় আসাম মুসলিম লীগের সম্মেলন।
১৯৪৫: পূর্ব বাংলায় এবং আসামে ব্যাপক সফর।
১৯৪৬: পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচনী আন্দোলন । মে মাসে আসামের বাস্তুহারা অসহায় মানুষের অধিকার আদায় করতে অনশন। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীতে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠান।
১৯৪৭: ৫ মার্চ সমগ্র আসামে আন্দোলনের ডাক। আসাম দিবস পালনের প্রস্তুতিতে সংগ্রামী ঘোষণা। ডুরাং ত্যাগের নির্দেশ অমান্য করায় কারাবরণ। ২০ জুন জোরহাট জেলা হতে মুক্তি লাভ। পূর্ব বাংলায় আগমন। ঐতিহাসিক আসাম- জীবনের অবসন।
১৯৪৮: ১৭ মার্চ পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক সভায় বাংলা ভাষার পক্ষ সমর্থন। পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী গ্রæপ সংগঠন। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশ।
১৯৪৯: ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা। সভাপতির পদ গ্রহণ। অক্টোবরের পূর্ব বাংলার খাদ্যাভাব ও মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে জনসভা এবং বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দান। কারাবরণ। পাকিস্তানের বিশেষতঃ পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে বিরোধী দলীয় আন্দোলনের পত্তন।
১৯৫০-৫১: কারাবাস এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ এর সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যপক কর্মসূচী বাস্তায়ন।
১৯৫২: সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ- এর সভাপতি হিসাবে মহান ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান। ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজায় ইমামতি। ২৩ ফেব্রুয়ারি কারাবরণ।
১৯৫৩: এপ্রিল মাসে কারামুক্তি। ডিসেম্বরে যুক্তফ্রন্ট গঠন।
১৯৫৪: ২১ দফা ইশতেহার নিয়ে নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ। বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য ইউরোপ সফর । প্রত্যাবর্তনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ।
১৯৫৫: ২৫ এপ্রিল দেশে প্রত্যাবর্তন। ১৫ জুন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে জনসভা। আওয়ামী মুসলিম লীগ দলের আওয়ামী লীগ নামকরণ। নভেম্বরে কাগমারীতে কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠান।
১৯৫৬: প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন। ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দান। মিসর আক্রমণ করায় মিত্র শক্তি বিরোধী আন্দোলন। ফুলছুরি ঘাটের সম্মেলনে কৃষক সমিতি প্রতিষ্ঠা।
১৯৫৭: ৬ হতে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন। পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে বিখ্যাত “আসসালামু আলাইকুম” ঘোষণা। মার্চে বিরোধ দেখা দেওয়ায় আওয়ামী লীগ হতে পদত্যাগ। ২৬ জুলাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রতিষ্ঠা। বগুড়ায় কৃষক সম্মেলন। খাদ্য- সংস্কট, স্বায়ত্বশাসন ও পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে অনশন।
১৯৫৮: সামরিক আইনে অক্টোবরে কারাবরণ। ১৯৬২ তে মুক্তিলাভ।
১৯৬৩: মহাচীন সফর। ডিসেম্বরে আইন অমান্য আন্দোলন ষোঘণা।
১৯৬৪: হাভানায় ও টোকিওতে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদান। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবিত করণ।
১৯৬৫: আইয়ুব- বিরোধী নির্বাচনে মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে অংশ গ্রহণ। পাক-ভারত যুদ্ধে দেশপ্রেমিকের অনন্য ভূমিকা পালন।
১৯৬৬: ন্যাপের পক্ষ হতে বিখ্যাত ১৪ দফা দাবী উত্থাপন।
১৯৬৭: রংপুর সম্মেলনে ন্যাপের বিভক্তি। তত্ত¡গত প্রশ্নে মহাচীনের সমর্থনে ন্যাপের অবস্থান।
১৯৬৮: ১০ দফা “দাবি সপ্তাহ” পালন। আইয়ুব শাহীর পতন ঘটানোর লক্ষ্যে ঘেরাও আন্দোলনের ডাক। গভর্নর হাউস ঘেরাও। হরতাল।
১৯৬৯: আইয়ুব আহূত গোলটেবিল বৈঠক বর্জন। সামরিক শাসন ও আইন উপেক্ষা করে শাহপুরে বিখ্যাত কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠান।
১৯৭০: সন্তোষে জানুয়ারিতে ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলন, পাকিস্তানের টোবাটেক সিং-এ মার্চে কৃষক সম্মেলন, পাঁচবিবির মহিপুরে এপ্রিলে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠান। জুন মাসে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন। ৮ সেপ্টেম্বর সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়-এর পত্তন ঘোষণা। নভেম্বরে জলোচ্ছ্বাস-বিধ্বস্ত এলাকায় ব্যাপক সফর। ২৩ নভেম্বর পল্টনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিষোদগার। ৪ ডিসেম্বর পল্টনের জনসভায় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ঘোষণা। সেদিন তাঁর বিখ্যাত উক্তি : লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালইয়া দ্বীন। সকল প্রকার নির্বাচন বর্জন।
১৭৭১: ৭ জানুয়ারিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ৫ দফা কর্মসূচী ঘোষণা। ৯ জানুয়ারি সন্তোষ দরবার হলে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান। ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্তোষ দরবার হলে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা ও কৃষ্টি সম্মেলন অনুষ্ঠান। এক দফা দাবী তথা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনমত সৃষ্টি করতে দেশ ব্যাপী ব্যাপক সফর। ৯ মার্চ পল্টনের জনসভায় স্বাধীনতার দাবীতে আপোষহীন থাকার আহ্বান। ১২ মার্চ ময়মনসিংহে কৃষক সম্মেলন। ৪ এপ্রিল এবং ৬ এপ্রিল পাক-বাহিনীর মোকাবিলা এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কারণে প্রাণ রক্ষা। ১৬ এপ্রিল রৌমারীর সীমান্ত পথে ভারতে প্রবেশ। স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রামে ভারতে অবস্থান। গৃহবন্দীত্ব বরণ।
১৯৭২: ২২ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্তোষে রাজনৈতিক সমাবেশ। আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ। ৯ এপ্রিল ঢাকার পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনসভা। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত। ডিসেম্বরে নিখিল বাংলা জোয়ান-কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠান।
১৯৭৩: খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ও অন্যান্য ইস্যুতে ভুখা মিছিল পরিচালনা ও অনশন। আইন অমান্য আন্দোলন। ১২ ডিসেম্বর সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সম্মেলনে অনুষ্ঠান।
১৯৭৪: দেশব্যাপী ভুখা মিছিলের ডাক। দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে আন্দোলন। সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু। ৭ এপ্রিল সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সম্মেলন। ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতির প্রতিষ্ঠা ও সম্মেলন অনুষ্ঠান। ১৪ এপ্রিল পল্টনে জনসভা। ২৯ জুন ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলে নেতৃত্ব দান। ৩০ জুন হতে সন্তোষে স্বগৃহে অন্তরীণ।
১৯৭৫: সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজে আতœনিয়োগ। ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবকে সমর্থন দান। ৭ ডিসেম্বর সন্তোষে চাষী সম্মেলন অনুষ্ঠান।
১৯৭৬: জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক সফর। ভারতীয় হামলার প্রতিবাদ। ২৭ ফেব্রুয়ারি খুলনায় গুরুতর অসুস্থ। ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ফারাক্কা মিছিলের ডাক। ১৬ ও ১৭ মে রাজশাহী হতে কানসাট পর্যন্ত ফারাক্কা মিছিলে নেতৃত্বদান। আগস্ট-সেপ্টেম্বর লন্ডনে চিকিৎসার্থে অবস্থান। অক্টোবরে খোদায়ী খিদমতগার প্রতিষ্ঠা। ১৩ নভেম্বরে সন্তোষ দরবার হলে খোদায়ী খিদমতগার সম্মেলনে জীবনের সর্বশেষ ভাষণ দান। ১৭ নভেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৯ নম্বর কেবিনে রাত সাড়ে সাতটায় ইন্তেকাল। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
১৮ নভেম্বর বাদ আসর পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সন্তোষে সমাহিত।


তথ্যসূত্রঃ 
 সৈয়দ ইরফানুল বারীর বিভিন্ন লিখা ও পঞ্জিকা 
উইকিপিডিয়া এবং অনলাইন

সংকলনঃ   
জাফর মুহাম্মদ    

কোন মন্তব্য নেই