আমাদের লেখক হয়ে যাবার তাড়া অনেক!

 আজকে যদি আমি  আবিষ্কার করি, "আমি লিখতে জানি" কালই নামের পাশে" লেখক" শব্দ যুক্ত করে দিতে হবে। এমনকি কতটা জানি সেটা জানার পূর্বেই।একটা বই বের করতেই হবে নইলে আর জাতে উঠা যায় না!  

কোন সেলিব্রিটি লেখককে  নিয়ে, তাদের লেখা নিয়ে অর্থাৎ সাহিত্য নিয়ে যখন আলোচণা, সমালোচনা হয় সেসব নিউজফিডে ঘুরতে থাকলেও না দেখি না দেখি ভান করে থাকতে হয় । আবার পোস্টটা পড়লেও মন্তব্য পড়া  কিংবা করতে ইচ্ছে  হয়না। আসলে অনেক বেশী মতামত চোখে পড়লে নিজের ব্যাক্তিগত মতামতে সেটার প্রভাব পড়ে। নিজের সেসব উপলব্ধি যা একটু একটু   তৈরী হয়েছে সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হয়। আসলে শব্দের শক্তি ই  এমন মানুষকে প্রভাবিত করা যায়, হঠাৎ সিদ্ধান্ত পাল্টে দেওয়া  যায়, আবার সবাই মতামত দিচ্ছে আমাকেও দিতে হবে সেই জাহিরের চেষ্টা থেকে যা আমরা বিশ্বাস করিনা তাও তুলে ধরা হয়ে যায়। এই হযবরল অবস্থায় সব নিয়ে কথা হয়, জ্ঞানের মেলা বসে, চুল চেরা বিশ্লেষণ হয় তবুও  কিছু একটা, নয়ত অনেক কিছুই রয়ে যায়। 

আমি খুবই  সাধারণ মানের পাঠক। তবুও সাহিত্যকে যেহেতু ভালোবাসি তার ভালোকে ভালোবাসি আবার মন্দ নিয়েও মনে মনে উদ্বিগ্ন হই।আমার মনে হয় আমরা সহজ পাঠ্যে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। যা একটু গভীর, যা পড়ার পর বোঝার জন্য একটু থেমে যেতে হয় সেসবে আমাদের অনেক অনীহা। এমন অনেক পাঠক আছে যাদের যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন," তুমি কি পড়তে পছন্দ কর?" সে বলবে", আমি  গল্প পড়তে  অনেক পছন্দ করি, আমি গল্প পেলে নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে গল্পে বুঁঁদ হয়ে থাকি। " আপনার যদি সাহিত্যপ্রীতি থেকে থাকে নিসন্দেহে আপনি খুশী হবেন, ভাববেন,  বাহ!  তার সাথে তাহলে বই  নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে।তারপর সে আপনাকে পাল্টা প্রশ্ন করবে, এই আপুর এই গল্পটা পড়েছেন? অই ভাইকে চিনেন না?  হায় আল্লাহ কি বলেন!  তাহলে কি পড়েন আপনি!নাওয়া, খাওয়া ছেড়ে গল্পে বুঁঁদ হয়ে থাকা মেয়েটির হাতে যদি একটা শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ,মানিক কিংবা বিখ্যাত কোন বইয়ের অনুবাদ  তুলে দেওয়া হয়  সেটা ঘরের এ কোনায় ও কোনায় পড়ে থাকবে আর মলাট ভারী হতে থাকবে ধূলার আস্তরণে। কেন হয় এমন!   পড়তে ভালোবাসে  অথচ  কেন এতো অনীহা তাদের  এসবে, যা আমাদের কাছে রত্ন সমতূল্য হওয়া উচিত ?

ফেসবুক নিজের যোগ্যতা তুলে ধরার ভালো প্রচার মাধ্যম। এটা সাহিত্য অনুশীলনের জন্য,  পাঠক তৈরীর জন্যও ভালো জায়গা। এখানে সাহিত্যের মত কিছু লেখার আমরা চেষ্টা করি তবে সেটা পুরোপুরি সাহিত্য সমৃদ্ধ নয় সেটা যেন আমরা স্বীকার করি। কেন নয় বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি।আমরা যারা পড়তে পছন্দ করি হয়ত লিখতেও তারা বিভিন্ন লেখকদের সাথে, অনেক, অনেক লেখালেখি নির্ভর গ্রুপের সাথে যুক্ত থাকি। হাজার হাজার গল্প  বিনামূল্যে চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেখানে কেন আপনারটাই পড়বে?  পড়বে কারন আপনি  তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করবেন প্রথম লাইনটা দিয়ে নয়ত প্রথম প্যারাটা দিয়ে।এখানে ভূমিকার সুযোগ নাই, একটু একটু করে সাহিত্যমান রক্ষা করে পারিপার্শ্বিকতা বর্ননা করে  মূল প্লটে এগোনোর বদলে  প্রথম লাইনেই আপনাকে  মূল বিষয় তুলে ধরতে হবে, পাঠক টানতে হবে অন্যথায় অপশনের অভাব নাই। পাঠককে টানার এই প্রথম লাইনটা কি হতে পারে?  পিরিয়ড, ধর্ষন, পরকীয়া,  খুন,ইভ টিজিং , উত্তেজক কোন বাক্য  ( আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারনে অনেক কিছুই মনে আসছেনা) এসব কি টানেনা আমাদের?না মনে হলে এমন লেখা অহরহ সামনে আসে একটু খেয়াল করে দেখার অনুরোধ রইলো।  একটা লাইন দিয়ে পাঠককে টেনে নিতে হবে শেষ পর্যন্ত। আমার এই লেখাটার প্রথম লাইনের মতই,  " আমাদের লেখক হবার তাড়া অনেক" এই লাইনটা আমি আরও পরে আনতাম,  দৃষ্টি আর্কষনের জন্যই কোন ভূমিকা ছাড়াই প্রথমে এনেছি।পাঠক ধরার এই প্রক্রিয়ায় সাহিত্যমান বজায় থাকে কতটুকু? আর সাহিত্য মান বজায় রেখে পাঠক পাওয়া যায় কয়জন? বিভিন্ন সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত গ্রুপগুলোতে আমি মাঝেমধ্যে চোখ বুলাই। অনেক পাঠক পেয়েছে এমন লেখাগুলো পড়ি আবার একেবারেই পাঠক পায়নি এমন লেখাও পড়ি বোঝার জন্য, এসব পড়লো না কেন কেউ? খুবই কি অখাদ্য এসব?  কিছুই কি নেই?  মাঝেমধ্যে চমকে যেতে হয় অবহেলায় পড়ে থাকা এসব লেখার গভীরতা ধরতে পেরে।আমি একটা এমন অবহেলায় পরে থাকা কবিতা পড়েছিলাম। লেখকের নাম মনে নাই। সে তার ভালোবাসার তুলে ধরতে গিয়ে আদিম যুগ থেকে শুরু করে, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস কিছুই আর বাদ রাখেনি এবং কাঠিন্যের সাথে গভীরতাও ছিল সেখানে অনেক। এমন অনেক সুপাঠ্যও পড়ে রয় অবহেলায় দেখে মনটা খারাপ হয়েছিল। মূল বিষয়ই একটাই যা ভাবতে হয়, যা গভীর, যা কোলাহলে দাঁড়িয়ে,  নিজের প্রয়োজনীয় কাজটা করতে করতে পড়তে পারিনা সেসব আমরা ছুড়ে ফেলছি আর সান্ত্বনা হিসেবে গিলছি সহজ কিছু। আমদের এই সহজ পছন্দে  আমরা বঞ্চিত হচ্ছি  জীবনবোধ, দার্শনিকতা, আর ভাবনার গভীরতা থেকে।বই পড়ার ধৈর্য্য আমাদের নাই। এতো ভূমিকা,ভাষার সৃজনশীলতা এসব আমাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। অথচ এই দূর্বোধ্যটুকু বেধ করা যে কতটা তৃপ্তির এবং সেসব  ভাবনায়, চিন্তা চেতনায়,  জীবন দর্শনে কতটা স্থায়ী আর রুচিশীল ছাপ রেখে যায় সেটা কি  আমরা জানি?


অনেকেই ভালো লিখে তবে আলোতে আসতে পারে কয়জন? এক্ষেত্রে নিসন্দেহে তারা যোগ্য তবে ভাগ্যবানও।একজন সাধারণ মানের পাঠক হিসেবে মাঝেমধ্যে আমার লেখকদের অনুরোধ করতে ইচ্ছে করে,   একজন লেখকের  লেখা যদি দুইহাজার পাঠক পড়ে তারা যেন খেয়াল করে কারা পড়ছে এসব। যদি একশত ভাগের আশি ভাগই টিনেজ হয় তারা যেন তাদের লেখার মান নিয়ে আরেকটু ভেবে দেখে। এটা মোটেও আশার কিছু নয় বরং হতাশার।এর অর্থ তারা সাহিত্য জ্ঞান সমৃদ্ধ পাঠক টানতে পারছেনা। আর  লেখকেরা যেন বারবার এই বিষয়টাতে স্পষ্ট হয় এবং প্রকাশ্যে তুলে ধরে, ফেসবুকে লিখছি প্রস্তুতি হিসেবে এটাই মূল সাহিত্য নয়। আর যে সব কিশোর কিশোরী তাদের আদর্শ হিসেবে মানে তাদের কাছে লেখকেরা  তাদের নিজেদের আদর্শ এবং যেসব পড়ে সে লিখতে আসে সেসব যেন তুলে ধরে। অর্থাৎ সে ই সর্বশ্রেষ্ঠ নয়, আরও অনেক পড়তে হবে  এই মেসেজটা যেন পৌছে দেয়। এক্ষেত্রে নিজের পড়া বইগুলোর বিষয় নিয়েও তারা লিখতে পারে অনেকে লিখেও। আসলে কৃত্রিমতা মানুষকে দূরে ঠেলে অস্বাভাবিকও করে। একটু সহজ হয়ে বিষয়গুলো সহজ করে দেখলে বিষয়গুলো এত জটিল না। হয়ত মানুষের মাঝে নিজেকে পৌছে দেওয়াও এত কঠিন না।

  সাহিত্যকে সমৃদ্ধ  করতে লেখক পাঠক  দুজনের দায়ীত্বই কিন্তু সমানে সমান। তবে এক্ষেত্রে পাঠকের সুবিধা একটু বেশী বোধহয়। তারা আক্রমনাত্মক সমালোচনাকেও সাহিত্যিক সমালোচনা নাম দেয়ার বৈধতা রাখে। এক্ষেত্রে সমালোচনা যেন শুধরে দেওয়ার জন্য হয় একেবারে কলম থামিয়ে দেওয়ার জন্য না হয়। আমদের ভিতরটা থাকে ভাঙাচোরা আর বিভিন্ন  ঘাত প্রতিঘাটে ফাটলে ভরা। সে ফাটলের ভিতরে আবার থাকে আশা, হতাশা, ব্যার্থতা, অপ্রাপ্তি। একটু সুযোগ পেলেই সেসব বের হয়ে আসতে চায়। এসব ব্যাক্তিগত হতাশার প্রভাব যেন সাহিত্য সমালোচনার উপর না পড়ে, এই আশাটুকু করা যেতেই পারে।    কোন আলোচনার জন্য এমনকি নেতিবাচক সমালোচনার জন্যও ব্যাক্তিগত সম্মান রক্ষা করে এমন কিছু উপযুক্ত  শব্দ নির্বাচন যে পড়তে জানে তার জন্য নিশ্চয়ই কঠিন কিছু নয়।অবহেলায় পড়ে থাকা  একটা ভালো   কবিতার কথা উদাহরণ হিসেবে  বলেছিলাম, এখন সেই ভালো মানের কবি যদি পাঠকের  রেস্পন্স না পেয়ে তার লেখনী শক্তি থামিয়ে দেয়, আর প্রথম লাইনেই উত্তেজক শব্দ ব্যবহার করে হাজার হাজার পাঠক পাওয়া লেখক যদি এমনই লেখার একটা বই ছাপিয়ে ফেলে তার দায় কিন্তু পাঠক পুরোপুরি এড়াতে পারেনা।সরাসরিই বলা  উচিত  সাহিত্য জগতের সুদিন কিংবা দূর দিন এখন যে-ই অবস্থানেই আছে তাতে পাঠক কিংবা লেখকের অবদান এবং দায় সমানে সমান। 


ফারজানা আলম

কোন মন্তব্য নেই