বন্ধুত্বের উপহার সীমান্ত হত্যা


বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে সীমান্ত রয়েছে ৪০৯৬ কিলোমিটার। বিশ্বের অন্যান্য সীমান্তের মত বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে রয়েছে নানা সমস্যা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা। নারী-শিশু পাচার, অস্ত্র পচার, সীমান্তবর্তী দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ। দুই দেশের মধ্যে বৈরি সম্পর্কের কারণে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা ইত্যাদি। এসকল সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নানা সময়ে নানা চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি -  ১৯ মার্চ ১৯৭২ ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয় এই চুক্তি। ১২ টি ধারা সম্বলিত এই চুক্তিটি ছিলো ২৫ বছর মেয়াদী এবং নবায়নযোগ্য।
মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চুক্তি - এই চুক্তিটি ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত হয়।
সীমান্তহত্যা শূন্যে নামানো - এই চুক্তিটি ২০১১ সালে বিজিবি এবং বিএসএফ এর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। 
সব চুক্তিতেই উভয় দেশের সমান সুযোগ এবং কোন সমস্যা উদ্ভূত হলে তা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের কথা বলা হয়েছে।
সকল চুক্তি আর সমঝোতা উপেক্ষা করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুসকে গুলি করে, নির্যাতন করে হত্যা করছে। ‘অধিকার’ সূত্রে জানা যায় বিএসএফ ২০১৮ সালে ১৪ জন, ২০১৯ সালে গুলি করে ৩৮ জন সহ মোট ৪৩ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে।  চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২৮ দিনেই হত্যা করে ২০ জন বাংলাদেশিকে। ২১ থেকে ২৩ জনুয়ারি ৩ দিনে হত্যা করা হয় ৭ জন। সীমান্ত হত্যা এখন যেন সাভাবিক ব্যাপাওে পরিনত হয়ে গেছে বিএসএফের জন্য! ঊাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে চুপ থাকলেও জনগণের ভেতরে ক্ষোভ দানা বাধছে, প্রতিবাদ চলছে রাজপথে। সামাজিক মাধ্যমে চলছে নিন্দার ঝড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বন্ধের দাবিতে গত ৫ দিন ধরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। অনশন করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম এবং বিইউপির শিক্ষার্থী নাজমুল করিম রিটু। প্রতিবাদি সভা-সেমিনার করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
ফেলানী হত্যা
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি শুক্রবার সকালে গুলি করে বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ সারে চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকার পর ফেলানীকে ৩০ ঘণ্টা পর ফেরত দেয় বিএসএফ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপে ১৩ সালের তেরই আগস্ট বিচার শুরু করে ভারত। ৬ সেপ্টেম্বর আসামি খালাস পায়। ১৪ জুলাই মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) সুপ্রিম কোর্টে রিট করে। ৬ অক্টোবর আবার শুনানি শুরু হয়। ২০১৬-১৭ সালের কয়েক দফা পিছিয়ে ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য হলেও আজ পর্যন্ত ঐ শুনানি হয় নি। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রেকর্ড অনুযায়ী পহেলা জানুয়ারি ২০০০ সাল থেকে অক্টোবর ২০১২ পর্যস্ত ১০৬৪ জনকে হত্যা করে বিএসএফ। জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত বিএসএফ হত্যা করে ৪৫৫ জনকে, হামলা করে আহত করে ৬৫৭ জনকে, অপহরণ কওে নিয়ে যায় ৫১৮ জনকে। ভারতের সাথে তার আশপাশের ছয়টি দেশের স্থলসীমা রয়েছে পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার সাথে সমুদ্রসীমা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাতীত অন্যান্য সীমানায় এমন হত্যা শূন্যের কোঠায়। ২০১৭ সালে একটি এবং গত কয়েকদিন আগে একটিসহ নেপাল সীমান্তে এমন হত্যার ঘটনায় নেপালের জনগণের বিক্ষোভ এবং নেপাল সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে ভারত সরকার ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে দিনের পর দিন এমন হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় বাহিনী। আজ পর্যন্ত কোন হত্যার বিচার হয় নি।
প্রথমত - বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মেরুদন্ডহীনতা এবং একতরফা ভারত তোষণ নীতিই এমন বর্বর হত্যাকান্ড চালিয়ে যেতে প্ররোচিত করে। বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এ ঘটনার প্রতিবাদ না কওে উলটো বাংলাদেশী নাগরিকদেরই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিলেন। তিনি এক সভায় বলেন- আর আসলে আমাদের চরিত্র যদি ভালো না হয় পরের দোষ দিয়ে লাভ নেই, এখানে দোষ বাংলাদেশী নাগরিকদের সুতরাং সরকারের কিছুই করার নেই। কার্যত বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা বন্ধে কোনো প্রকৃত আগ্রহ বা উদ্যোগ এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান হয় নি।
দ্বিতীয়ত -  বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের কোন নাগরিক ভারত সীমান্তে ভুলবশত বা  অবৈধভাবে প্রবেশ করলে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে একতরফাভাবে ভারতীয় বাহিনী সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদেও সরাসরি গুলি করছে এবং হত্যার কথা অস্বীকার করছে। তারা বলছে যে, তাদের ওপর হামলা হলে তারা নন-ল্যাথপাল (প্রাণঘাতী নয় এমন বুলেট) গুলি করে যা সম্পূর্ণ বানোয়াট। প্রকৃত চিত্র হলো- ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ সীমার দুই থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ঢুকে বাংলাদেশের নিরীহ নাগরিকদের উপর দিনে এবং রাতের আঁধারে হামলা করে, নির্যাতন করে, গুলি করে, অপহরণ করে নিয়ে যায়। এমন অসংখ্য ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে।
পৃথিবীতে বিপদজনক সীমান্ত হিসেবে আমরা যেগুলোকে চিনি এরমধ্যে নাম করে বলতে গেলে বলা যাবে আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্ত, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত,ভারত-চীন সীমান্ত, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সীমান্ত। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সীমান্তেও এত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে না। অথচ বাংলাদেশ এবং ভারত নিজেদেরকে পরস্পরের সবচেয়ে ভালো বন্ধু বলে দাবি করে।  স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৮ বছরে একতরফাভাবে ভারত কেবলমাত্র তাদের সুবিধাই আদায় করেছে বাংলাদেশ কাছ থেকে।

সার্বভৌমত্তের প্রশ্নঃ

১৯৭২ সালের মুজিব ইন্দিরা স্বাক্ষরিত ভারত বাংলাদেশ মেত্রী চুক্তি চুক্তির প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে -
‘চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ্য স্ব স্ব দেশের জনগণ যে আদর্শের জন্য একযোগে সংগ্রাম এবং স্বার্থত্যাগ করেছেন সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছে যে, উভয় দেশ এবং তথাকার জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও মৈত্রী বজায় থাকবে। একে অপরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখÐতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং অপরের অভ্যান্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে অবিচল থাকবে। চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ উল্লেখিত নীতিমালা এবং সমতা ও পারস্পরিক উপকারিতার নীতিসমূহের ভিত্তিতে উভয় দেশের মধ্যেকার বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সুপ্রতিবেশীসুলভ সার্বিক সহযোগীতা ও সম্পর্কের উন্নয়ন আরও জোরদার করবে’।
কিন্তু ভারত সরকার গত ৪৯ বছরেও তার কথা রাখেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে সীমান্তে একের পর এক বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে। এখনো এই হত্যাকাÐ অব্যাহত রেখেছে। সীমান্তে মানুষ হত্যা স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ।

করনীয়ঃ

এমন পরিস্থিতিতে সার্বিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের ২ টি করণীয় হতে পারে

১. বাংলাদেশের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতিকে শক্তিশালী করা এবং সীমান্তে নিরিহ বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার দায়ে ভারত সরকারকে কুটনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা এবং অবিলম্বে হত্যাকান্ড বন্ধ করতে বাধ্য করা।

২. তাতেও কাজ না হলে সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা।

কোন মন্তব্য নেই