এন আর সি (NRC)এবং সি এ এ(CAA), বিভাজনের রাজনীতিতে ভারত
এন আর সি ( NRC) কি এবং কেন?
ভারতে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) এবং সিটিজেনশীপ এমেন্ডমেন্ট এক্ট (CAA) কে কেন্দ্র করে পানি অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। ভারত একটি বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও দেশটি এখন এন আর সি এবং সি এ এ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের দিকে এগিয়ে গেছে। এন আর সি সমস্যার মূল খুঁজতে আমাদের যেতে হবে পিছনের দিকে। ১৯৭৮ সালে আসামে কংগ্রেসকে পরাজিত করে জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের লক্ষে কংগ্রেস 'বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী' শ্লোগান তোলে। তারা বলতে শুরু করে সীমান্ত দিয়ে লাখ লাখ বাংলাদেশীর অনুপ্রবেশ করে। কংগ্রেসের এই শ্লোগান লুফে নেয় আসামের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী ছাত্র সংগঠন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) এবং অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ। ১৯৭৯ সালে লোকসভা উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা অনুপ্রবেশকারীদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবী করে। এ সময়ই গড়ে ওঠে বাঙালী খেদাও আন্দোলন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলন চলে।
সত্যিই কি আসামে লক্ষ লক্ষ বিদেশী অনুপ্রবেশ ঘটেছে?
অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ (এ জি পি) সরকার ১০ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে অভিযান চালিয়েও অনুপ্রবেশকারী খুঁজে পায়নি। কিন্তু তারা নতুন বুদ্ধি আবিষ্কার করে, ডি-ভোটার চাতুরী। ১৯৯৭ সালে এ জি পি কোন জরিপ বা খোঁজখবর ছাড়াই হঠাৎ ৩ লক্ষ ৭০ হাজার ডাউটফুল বা সন্দেহজনক ভোটার আছে বলে ঘোষণা দিল। কোন ব্যাখ্যা ছাড়াই নানা আইনি,অ-আইনি প্রক্রিয়ায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার ভোটার 'ডি ভোটার' হিসেবেই থেকে গেল। এখনো তারা আসামে ভোট দিতে পারেননা।
মোদীর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি
এমন সময় মোদী সরকার আসামে এন আর সি ঘোষণা করল যখন আসামে- অসমিয়া, বাঙালী অসন্তোষ প্রায় নেই বললেই চলে। ১৯৮৫ সালে যে 'আসাম চুক্তি' হয়েছিল তার অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল 'নাগরিক পঞ্জি' তৈরি করা। গত ৩৪ বছর এ সমস্যার যৌক্তিক সমাধান না করে বিজেপি সরকার আরোও কট্টর অবস্থান নিল। ভোটার সংখ্যার হিসাব-নিকাশে আবার আসামে জনগনের মধ্যে একটি বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। বিজেপি সভাপতি অমিত সাহা ১৭ই ফেব্রুয়ারি জনসম্মুখে ঘোষণা করেছিল যে,"আসাম থেকে বাঙালী-মুসলমান খেদানো হবে।"
গুয়াহাটি প্রাগ নিউজ এর প্রধান সম্পাদক এবং অসমীয় ভাষার প্রধান সাংবাদিক অজিত ভুইঞা বলেন, "বাঙালী-অসমীয়া ধেরিজ এখন প্রায় নেই।"
আসামে বিজেপি জনসমর্থন বাড়াতেই মূলত অনুপ্রবেশ সমস্যাকে আবার জীবিত করেছে।এতে বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী, নিরাপত্তা ইত্যাদি সমস্যাকে আড়াল করা হয় এবং বাঙালী মুসলমান বিরোধী ক্ষোভও প্রয়োগ করা যায়। কিছু মানুষ তাদের এই অপপ্রচারে বিশ্বাস করে ঠকেছেনও।
জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (যদিও এটি মোটেও জাতীয় নয়, আসামকে কেন্দ্র করেই তা করা হচ্ছে।) আসামে কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে - আইনি ভাষায় বলা যায় " Innocent until proven Guilty" অর্থাৎ একজন মানুষকে নিরপরাধ হবে যতোক্ষণ না সে অপরাধী প্রমাণিত হয়।
কিন্তু এন আর সি এর মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্র তার নাগরিককে বলছে,"you are Guilty until proven innocent" অর্থাৎ আপনি অপরাধী যতোক্ষণ না আপনি প্রমাণ করতে পারছেন আপনি নিরপরাধী"। জনগনকে প্রমাণ করতে হবে যে,তিনি ঐ দেশের নাগরিক যদি তিনি প্রমাণ না করতে পারেন তাহনে তিনি ঐ দেশের নাগরিক নন। যে সকল শর্তগুলো যুক্ত করা হয়েছে সে শর্তগুলো অধিকাংশ মানুষ পূরণ করতে সক্ষম নন। বাপ-দাদার জন্ম সন্দ,আধার কার্ড, জমির দলিল, ভোটার আইডি কার্ড ইত্যাদি। কাগজপত্র কোথায় পাবে? দেখা গেছে যাদের কিছু কাগজপত্রও আছে সেগুলোতেও নামের বানান ভুল,ছবি একজনের নাম আরেকজনের সমস্যা, ফলে বিশেষত গরীবমানুষ কোন ভাবেই প্রমাণ করতে পারবেননা তারা ভারত দেশের নাগরিক দুই তিন পুরুষ ধরে ঐ অঞ্চলে বসবাস করলেও কিংবা নাড়ী পোতা থাকলেও।
এ বছর 'আওয়াজ' নামে একটি প্রভাবশালী অনলাইন এক্টিভিজম অয়েবসাইট ভারতে গবেষণা করে দেখিয়েছে - আসামে নাগরিক পঞ্জি হালনাগাদ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশী-মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামাজীক যোগাযোফগ মাধ্যমে ব্যাপকহারে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল। তারা আরোও জানায় মিয়ানমারে রোহিংগাদের গনহত্যার আগে যে ধরনের ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল আসামে এন আর সি চলাকালীন হেটস্পীচ গুলোর সঙ্গে তার মিল রয়েছে। এসব হেটস্পীচ সর্বমোট ৫৪ লক্ষবার দেখা হয়েছে এবং ১ লক্ষবার শেয়ার করা হয়েছে। ফেসবুক এবং হোয়াটস এপে হেটস্পীচ দেওয়ার তালিকায় আছেন প্রাক্তন আলফা নেতা এবং বিজেপি'র আইন প্রণেতাও।
অনুপ্রবেশের কারণে অসমিয়ারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে এবং তাদের সংস্কৃতি বিপন্ন হবে বলে যে প্রচার চলছে তাও ভিত্তিহীন। অসমীয় ভাষার জনগন গত ৫০ বছরের হিসেবে এখন বেড়ে প্রায় ৬০ ভাগের উপর। আর সাধারন মানুষের মেলামেশা ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয় বই অনুন্নত হয় না। এসব প্রচারণা মানুষকে ভাষা-ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করে শাসন পাকাপোক্ত করার চেষ্টা মাত্র। এ ক্ষেত্রে বিজেপি সরকার এককাঠি সরেষ।
২ লক্ষ ৫০ হাজার ডি-ভোটার শ যে ১৯ লক্ষ মানুষ নাগরিক নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়েছেন তাদের কি হবে?
এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সীমান্তে আসামে ৪৬ কোটি রুপি ব্যয়ে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি শুরু করেছে ভারত সরকার যেখানে ৩০০০ লোককে একইসাথে রাখা যাবে।(এরই মধ্য ৯ শতাধিক মানুষকে সেখানে রাখা হয়েছে যাদের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে।) এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯ লক্ষ মানুষের জন্য কতগুলো ক্যাম্প আর কত টাকা লাগবে?
সচেতন ভারতীয় নাগরিকগণ প্রশ্ন তুলেছেন- জনগনের করের টাকা এভাবে নষ্ট করছে সরকার? তার উপর যাদের জন্য এই টর্চারসেল তৈরি করা হচ্ছে তারা জানেইনা তাদের দোষ কি অথবা এটা প্রমাণিত নয় তারা ভারতের নাগরিক বা নাগরিক নন! এটা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে মোদি সরকার ভেবেছিল এন আর সি এর মাধ্যমে সংখ্যালঘু বাঙালী-মুসলমানদের কোনঠাসা করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে ভারতে বসবাস করতে বাধ্য করবে। কিন্তু দেখা গেল, নাগরিক পঞ্জি হতে বাদপড়া মুসলমানদের সংখ্যা ২ লাখের আসেপাশে, বাকি সবাই বাঙালী হিন্দু!
এন আর সি'র পরিকল্পনা ভেস্তে গেলে তারা নতুন নাগরিকত্ব আইন(সি এ এ) নিয়ে এল যার সারকথা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান হতে আগত অমুসলিম তথা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, জৈন, শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ আবেদনের ভিত্তিতে ভারতের নাগরিকত্ব পাবে। এই আইনের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের বাদ দিয়ে তাদের (বিজেপি'র) কট্টর সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী ভারত রাষ্ট্রের নকশা সামনে এল যা তারা বহুদিন থেকেই বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে।
অসাম্প্রদায়ীক রাষ্টের দাবী
এন আর সি এবং সি এ এ এর বিরুদ্ধে ভারতের সচেতন ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবি যে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন তা অভূতপূর্ব। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী হামলা করেছে এবং এ পর্যন্ত ৮ জনের অধিক মতান্তরে ২০ জনের অধিক মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ২ শতাধিক আন্দোলনকারীকে। ভয়ে আত্মহত্যা করেছেন কমপক্ষে ১৭ জন। নাগরিক স্বার্থের পক্ষে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় এন আর সি এবং সি এ এ এর প্রত্যাহারের দাবীতে শ্লোগান তুলেছেন। বহু শিক্ষক , বুদ্ধিজীবি , তারকারা রাস্তায় নেমে এসেছেন।
জাতিসংঘ খোলাখুলি ভাবে এই আইনের বিরোধীতা করে বলেছে,"এই আইন বৈষম্য সৃষ্টি করবে।"
এরই মধ্যে অন্তত চারটি রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী বলেছেন তাদের রাজ্যে এন আর সি এবং সি এ এ বাস্তবায়ন করবেন না। এ আইনের প্রতিবাদে আসামে খোদ বিজেপি'র একজন সংসদ পর্যন্ত পদত্যাগ করেছেন।
হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে হাতে হাত ধরে নাগরিক মর্যাদা রক্ষার আন্দলন করছেন।এ আইনের ফলে শুধু মুসলমান জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তা নয়।
অমিত সাহা সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন সি এ এ কার্যকর করার পর সারা দেশে এন আর সি করা হবে।
ফলে সারা দেশেই সাধারন মানুষের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে এবং এ আতংক থেকেই নিজেদের বাঁচাবার চ্যালেঞ্জ তারা গ্রহন করেছেন। ভারতের সাধারন মানুষ শাসকদের বিভাজনের রাজনীতি মেনে নেবেন নাকি ঘুরে দাঁড়াবেন তা সময়ই বলে দেবে।
লেখক:মিজান রহমান
রাজনৈতিক কর্মী

Post a Comment