প্রহসন : সাহিত্যে ও সমাজে



এক

প্রহসন একটি সাধিত বিশেষ্য শব্দ,উপসর্গ যোগে গঠিত।মৌলিক 'হসন'(যার অর্থ হাসি) এর পূর্বে উপসর্গ 'প্র' (যার অর্থ অধিক) যুক্ত হয়ে সাধিত 'প্রহসন' গঠিত হয়েছে। তাই বলা যায় প্রহসন শব্দটির আক্ষরিক অর্থ 'অতি হাসি'। হাসি সবার পছন্দের, ছোঁয়াচে; কিন্তু অতি হাসি অপছন্দের। প্রচলিত আছে, 'অতি হাসি পাগলামির লক্ষণ।' আবার বাংলা একাডেমী বলছে, প্রহসন শব্দের অর্থ দু'টি:
১. হাস্যরসপ্রধান নাটক।
২. ব্যঙ্গ বা বিদ্রূপ। 
 
দুই

'হাস্যরসপ্রধান নাটক' সবাই লিখতে পারেন। একজন বিত্তহীন, গরীব সাহিত্যিকও সাহিত্য রচনা করতে পারেন। সাহিত্য সবার জন্য তার দ্বার খুলে রেখেছে। প্রহসনে হাস্য ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের আবরণে সমাজের অনৈতিকতা, অনাচার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতা এবং প্রাত্যহিক জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতিসমূহ তুলে ধরা হয়। নকশাধর্মী কাহিনীর মাধ্যমে ঘটনা ও বিষয়বস্ত্তর অতিকথন, টাইপ চরিত্রের সংযোগ এবং হাসি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সহযোগে খন্ডজীবনের একটি উপভোগ্য নাট্যরূপায়ণই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায়, রামনারায়ণ তর্করত্ন সংস্কৃত প্রহসনের আদর্শে;বাংলা প্রহসন রচনার পথিকৃৎ। তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রহসন হচ্ছে কুলীন কুলসর্বস্ব(১৮৫৪)।আবার ,বাংলা সাহিত্যে প্রথম পাশ্চাত্যধারা তথা ইংরেজি পারছে-এর বৈশিষ্ট্য ও গুণ সমন্বিত প্রহসন রচনায় কৃতিত্বের অধিকারী হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মূলত তাঁর 'একেই কি বলে সভ্যতা(১৮৬০)' ও 'বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ(১৮৬০)' প্রহসনদ্বয়ের মধ্য দিয়েই বাংলা প্রহসন তার স্বকীয়তা লাভ করে। বাংলা সাহিত্যে অনেক 'প্রথম' এর সূচনাকারী তিনি,যেমন এদেশে অনেক ধরনের সভ্যতা ও উন্নয়নের 'প্রথম' সূচনাকারী বর্তমান সরকার'।

তিন

মধুসূদনের পাশাপাশি দীনবন্ধু মিত্র বাংলা প্রহসনকে আরও সমৃদ্ধি ও সার্থকতা দান করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রহসন 'বিয়ে পাগলা বুড়ো(১৮৬৬)'। তিনি এখন বেঁচে থাকলে হয়তো লিখতেন 'ক্ষমতা পাগলা মোড়ল'। এরপরে অমৃতলাল বসু,গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মনোমোহন বসু, রাজকৃষ্ণ রায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ সাহিত্যিক উৎকৃষ্ট মানের প্রহসনে বাংলা সাহিত্যকে অলঙ্কৃত করেছেন।

চার

বিশ শতকের প্রথমভাগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হলে প্রহসন রচনার তাগিদ ক্ষীণ হয়ে আসে। তাই পরবর্তীকালে আর প্রহসন তেমন রচিত হয় নি। বর্তমানে আন্দোলন দূরের কথা, কেউ জিজ্ঞাসা করতেও পারছে না 'রাজা,তোর কাপড় কোথায়?'। তবুও কোনো সাহিত্যিক প্রহসন রচনা করছেন না। এর তিনটি কারণ হতে পারে ঃ
১. তাঁরা 'প্রহসন' বলে যে কোনো সাহিত্য আছে তা জানেন না।
২. তাঁরা প্রহসন রচনায় অক্ষম ।
৩. তাঁরা সভাসাহিত্যিক/গৃহপালিত সাহিত্যিক। পৃষ্ঠপোষিতরা উৎকৃষ্ট সাহিত্যে গণমানুষের কথা বলতে পারেন না।
গণমানুষের কথা বলতে স্বাধীন বিবেক থাকতে হয়। আর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের জগতে সবার প্রবেশাধিকার নেই, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে পারেন শুধু ক্ষমতাসীনরা। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা আর প্রহসন রচনা এক নয়। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয় আমজনতাদের নিয়ে। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করুণ রসের সৃষ্টি করে, আর প্রহসন হাস্যরসের সৃষ্টি করে। আমরা হাস্যরস চাই, করুণরস সৃষ্টিকারীদের ধ্বংস চাই। আবার, আমরা ধ্বংস চাইতে গেলে মোড়লরা হাইকোর্ট দেখাবেন। বলবেন, 'শেকসপিয়র মহাসাহিত্যিক,মান্য ব্যক্তি। তিনি বলেছেন, "পৃথিবী একটি রঙ্গমঞ্চ।" আমরা এই কথাটিকেই বাঁচিয়ে রাখছি মাত্র; করুণরস আমাদের উদ্দেশ্য নয়, উপজাত।' মোড়লরা যেহেতু হাস্যরস সৃষ্টিতে রাজি নন, তাই ভাবলাম এই লেখায় কিছু কৌতুক সংযোজনের মাধ্যমে হাস্যরস সৃষ্টি করি। গুগলে সার্চ দিলাম 'প্রহসন নিয়ে কৌতুক' লিখে।গুগল প্রহসন সম্পর্কিত কৌতুক সরবরাহে ব্যর্থ হল। বরং কিছু নিউজ লিংক ধরিয়ে দিল। সেগুলোর মধ্যে একটির শিরোনাম - 'বাংলাদেশের প্রহসনের নির্বাচন নিয়ে কৌতুক করছে পুরো বিশ্ব'- নিউইয়র্ক টাইমস

কোন মন্তব্য নেই