প্লাস্টিকঃএকদা আশির্বাদ,এখন অভিশাপ!

প্লাস্টিকময় একটি মেয়র নির্বাচন ও একটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে হাইকোর্টের নির্দেশনায় উঠে আসার শেষ চেষ্টা। ধন্যবাদ জানাই যে বা যারা উদ্যোগটি নিয়ে সবার সাথে হাইকোর্টের দৃষ্টিগোচর করেছেন। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই বিচারকদেরও। তারাই আমাদের শেষ ভরসার জায়গায় অক্সিজেন দিচ্ছেন বলে।
প্লাস্টিক নিয়ে কেন এত কথা? উৎস অনুসন্ধান করে দেখলে কয়েকটা কারন খুব জোরালো হয়ে সামনে আসে। 

যেমন- 
১। প্লাস্টিক পচেনা। 
২। প্লাস্টিক থেকে নানান ধরনের বিষাক্ত রাষায়নিক উপাদান পরিবেশে ছড়ায়। 
৩। প্লাস্টিক পুড়িয়ে শেষ করে দিতে চাইলেও শেষ হয়না। পোড়ালে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী CO2 এর সাথে কয়েকটি বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ করে যা থেকে জটিল সমস্যা হয়।

প্লাস্টিক পচেনা এই দিয়েই বাকি আলোচনায় ঢুকা যাক। আচ্ছা কোনো জিনিস না পচলে কি সমস্যা কেউ ভেবে দেখেছেন? উত্তরটা দুই রকমের। একটা সমস্যা মানসিক। আরেকটা বাস্তব ব্যবহারিক জীবনের। মানসিক সমস্যাটা আমাদের ধর্মীয় অনুভূতির এবং মনস্তাত্ত্বিক গড়নের সাথে কিছুটা সম্পর্কিত। অবিশ্বাসী বাদে সাধারণ মানুষ সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কোনো অবিনশ্বরকে নিতে পারেনা - আমরা যখন কিছু একটা ফেলে দেই, অভ্যাসবসত আমরা আশা করি জিনিসটা পচবে। ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু একটা পেট (PET) বোতল বা একটা পলেথিন ফেলার পর ধরেন তার উপর মাটি চাপা দেয়া হলো। ৫০ বছর পর সেখানেই কোন কাজে মাটি খোড়া হলে দেখা যাবে বোতল আর পলেথিন অবিকল রয়েছে। দাঁত কেলিয়ে হাসছে। এই দেখাটা ঝট করে মানুষের মনে আরেক অবিনশ্বরের উপস্থিতির আতংক তৈরি করে। তার সমস্ত বিশ্বাসের গঠনটাকে একটা ঝাঁকি দিয়ে দেয়। এটা অবশ্যই একটা সমস্যা। এতো গেল মনের কথা। আসি দেখার দুনিয়ায়।

প্লাস্টিক, পলেথিন না মাটিতে ফেলার পর না পচলে আরো দুইটা ভয়ানক পরিবেশগত ও মানবিক সংকট হয়। পানির সংকট আর মাটির সংকট।

কোনো কিছু না পচলে মাটিতে, পানিতে বাস্তব কিছু ঝামেলা তৈরি করে। মাটির কথাই ধরা,যাক। মাটি আমাদের কেন লাগে এই প্রশ্নের উত্তরের ভেতর সেই সংকটগুলার বর্ননা আছে। মাটি আমাদের খাবার দেয়, মাটির উপরে এবং ভেতরে পানি ধরে রাখে। সবজি, উদ্ভিদ মাটির ভেতর থেকে নানান রকম পুষ্টি সংগ্রহ করে বেড়ে উঠে। সেগুলা খেয়ে বাকী প্রানীজগৎ টিকে থাকে। এখন যদি এমন হয় উদ্ভিদ যেখান থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে সেখানে শেকড় গিয়ে শুধু পলেথিন আর প্লাস্টিক পাচ্ছে, তাহলে উদ্ভিদ পুষ্টিটা কোথায় পাবে? সমুদ্রেও একই অবস্থা। যেখানে নানান প্রান সমুদ্রের ভেতরের ক্ষুদ্র অনুজীব, উপজীব খেয়ে বেঁচে থাকে তাকে খেয়ে বেঁচে থাকে তারচেয়ে বড় প্রানী, মাছ তারা যদি খাবার খেতে গিয়ে শুধু প্লাস্টিক আর পলেথিন পায় তাহলে তাদের খাবারের কি হবে? পাবেনা। এটাই সাধারন কথা।
এখন আসা যাক সমস্যার আরেক দিকে। প্লাস্টিক ও পলেথিন তৈরিতে হাইড্রো কার্বনের পলিমার ম্যাটেরিয়ালের সাথে বেশ কিছু ক্ষতিকর ও বিপদজনক রাষায়নিক ব্যবহার করা হয়। যেসব প্লাস্টিক এখন পর্যন্ত আমরা দেখছি তারমধ্যে পলি-ইথিলিন (Polyethylene),পলি ভিনাইল ক্লোরাইড (PVC), পলিস্টারইরিন (Polystyrene), পলিটেট্রাফ্লুরোইথিলিন বা Polytetrafluoroethylene (PTFE or Teflon), বিওপিপি বা BOPP (Biaxially Oriented Polypropylene) উল্লেখযোগ্য। এসব প্লাস্টিক ও পলেথিন তৈরিতে ব্যবহার হয় বিপিএ বা Bisphenol A (BPA), ফথালেট বা Pthalates, ডাইঅক্সিন, antiminitroxide, অগ্নি প্রতিরোধক বা Brominated flame retardants ও তাপ, স্ক্র্যাচ, পানিরোধক করার জন্য ব্যবহার হয় পলিফ্লোরিনেটেড রাষায়নিকের অনেকগুলো, সংক্ষেপে এগুলাকে বলা হয় PFAS অথবা Poly- fluorinated chemicals.
বিষাক্ত এসব রাষায়নিক প্লাস্টিক ও পলেথিন থেকে মাটিতে ও পানিতে মিশতে থাকে। শুধু মানুষেরই এসব বিষক্রিয়ায় চোখ জ্বালাপোড়া করা, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, নিঃস্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, শ্বাসযন্ত্রের নানান সমস্যা, লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া, ক্যান্সার, ত্বকের নানান রকম প্রদাহ, এলার্জি, ফুসফুসের সমস্যা, মাথাধরা, ঝিমঝিম অনুভুতি, নারী শিশুদের কম বয়সে পিরিয়ড, বয়সকালে সন্তান ধারনক্ষমতা কমে যাওয়া, মিসক্যারিজ, পুরুষের শুক্রানু কমে যাওয়া, শিশুর জন্মে নানান জটিলতা হওয়া, নারী পুরুষের গড়ে প্রজননের ক্ষমতা কমে যাওয়া, গ্যাস্ট্রোইনটেসটিনাল ও কার্ডিওভাসকুলারএর মতো জটিল সব সমস্যা। সহজেই বুঝা যায় বাকী প্রানীজগতও এসব রোগবালাই থেকে মুক্ত নয়।
সাধারণত লেমিনেশানের কাজে আগে PVC (Polyvinyl chloride) শিট ব্যবহার করা হতো। কিন্তু ইদানিং BOPP (Bi-axially Oriented Polypropylene) শিট ব্যবহার ক্রা হচ্ছে। কারন এটি আরো স্বচ্ছ, হালকা, ফ্লেক্সিবল। এছাড়াও PET (Polyethylene Terephthalate), EVA (Ethylene-Vinyl Acetate), PE Plastic (Polyethylene) ও লেমিনেশানে ব্যবহার করা হয়। পাতলা PVC ও BOPP শিট ইলেকশান পোস্টারের প্লাস্টিক লেমিনেশানে ব্যবহার করার পর খুব দ্রুত ফেলে দেয়া হয়। লংটার্ম কোন ব্যবহার উপযোগিতা না থাকায় তা ডাম্প করার ফলে দূষণ তৈরি করতে থাকে দ্রুত। এবারের মেয়র নির্বাচনে আনুমানিক এক কোটি লেমিনেটেড পোস্টার তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের লেমিনেশান ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করার কারনে এই লেমিনেটেড পোস্টারে ব্যবহৃত পলেথিনের মোট ভর নির্ণয় কঠিন। তবে এর অন্যরকম একটা ছবি আঁকা যায়। যেমন - একটা পোস্টারে কাটিং এর আগে প্রায় ৬ বর্গফুট প্লাস্টিক লেমিনেটেড অবস্থায় থাকে। রক্ষণশীল হিসাবে মেয়র নির্বাচনে ছাপানো পোস্টারের যে সংখ্যা তা দিয়ে পুরা ধানমন্ডি এবং শংকর ঢেকে ফেলা যাবে।
এসব প্লাস্টিকে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিককে আগের সকল উল্লখিত রোগের সাথে গড়ে সমাজের IQ কমে যাওয়া, কিছুকিছু ক্ষেত্রে অটিজমের জন্য দায়ী করা হয়। এরকম বেশকিছু হাই ইমপ্যাক্ট গবেষণাপত্র গত বছরগুলোতে পাবলিশ হয়েছে। কিন্তু পপুলার মিডিয়া এন্ড গভরনেন্স সিস্টেম এসব বৈজ্ঞানিক তথ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে কমই। সেকারনে শোনা যায় প্লাস্টিকের মানব দেহে সরাসরি শারীরিক ক্ষতি কম।
কিন্তু একটা বিষয়ে প্রায় সবাই একমত। তা হল বাতাস, মাটি, পানিতে প্লাস্টিকের প্রভাব। আমাদের নির্বাচনে যেসব প্লাস্টিক লেমিনেশানে ব্যবহার করছে তা কি কি ক্ষতি করতে পারে তার একটা হালকা ধারণা উপরে দেয়া হয়েছে। তার বাইরে এই প্লাস্টিকগুলো খুবই পাতলা। না পচলেও প্লাস্টিক মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিকে বিভক্ত হয়। এগুলোই মাটিতে অন্যান্য কনার সাথে মিশে থাকে । মাটির পুস্টির গুনগত মান খারাপ করে দেয়। উদপাদিত সবজি, ফলের সাথে মিশে যায়। পানিতে সকল জলজ প্রান ছোট ছোট কনায় বিভক্ত এসব প্লাস্টিক খেয়ে পেট ভরিয়ে রাখে। যা শেষ পর্যন্ত মানুষ সহ খাদ্য চক্রের উপরের দিকের সকল প্রানিদের শরীরে প্রবেশ করে। বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাখি। অসংখ্য পাখি প্লাস্টিক দূষণের কারনে মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। ডলফিন, তিমিতো আছেই। বাতাসে প্লাস্টিকের দূষণ হয় কয়েক রকমে। যেমন নির্বাচনে ব্যবহৃত লেমিনেটেড প্লাস্টিক খুব দ্রুত ডিসপোজ করা হবে। এমনিতেই আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুব দুর্বল। তার উপর যেখানেই ডাম্প করা হোক না কেন সেখানে দুইটা ঘটনা ঘটবে। এক - আগুন জ্বালিয়ে প্লাস্টিকের মোট ভলিউম কমানো হয়। প্লাস্টিক পোড়ানো হলে যে ধোয়া এবং গ্যাস নির্গত হয় তা Carcinogenic. প্লাস্টিকের ধোয়া থেকে যে ক্যান্সার হয় তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নাই বললেই চলে। প্রমানিত।
অন্যদিকে এসব প্লাস্টিক পোড়ানো না হলেও এগুলো ধীরে ধীরে মাইক্রো অার ন্যানো প্লাস্টিকের ছোট ছোট টুকরায় বিভক্ত হয়ে বাতাসে উড়তে থাকবে। একটা কথা সব জায়গায় শোনা যাচ্ছে। ঠিক কোন গবেষণা হয়নি এখনো। তবে হাইপোথিসিস। দুনিয়া জুড়ে যে ধরণের প্লাস্টিক দূষণ আছে তার কিছুটা দেখা যায়, কিছুটা দেখা যায়না। পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট থেকে তৈরি বলে প্লাস্টিক ভীষণ দাহ্য পদার্থ। বাতাসে যে ন্যানো প্লাস্টিকের কনা ভেসে বেড়াচ্ছে তা অনেকটা ফ্লোটিং ফুয়েল ইন দা এয়ার। ফলে কোথাও আগুন লাগলে ন্যানো প্লাস্টিকের কনা বার্নিং এক্সপানশানে এক্সিলারেটর হিসেবে কাজ করে। যার ফলে আগুন এতো দ্রুত ছড়ায় যে তা নিয়ন্ত্রন করা প্রায় অসম্ভব। হাইপোথিসিস হলেও এই ঘটনা গত বছর জুড়ে আমরা আমাজন, কঙ্গো, সাউথ অস্ট্রেলিয়ান ফায়ারে দেখতে পেয়েছি।
এতো গেল ফ্লোটিং ফুয়েল ইন দা এয়ার (Floating Fuel in the Air) এর কথা। প্যাথোজেন ক্যারিয়ার হিসেবে ন্যানো প্লাস্টিকের কথা জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। বাতাসের নানান দূষণের কারনে আমাদের বুদ্ধিমত্তা মারাত্মক রকমের কমে যাচ্ছে তা ২০১৮ সালের নভেম্বরে ইয়েল ইউনিভার্সিটি আর বেইজিং ইউনিভার্সিটির এক যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণাটি বলছে বুদ্ধিমত্তা কি পরিমাণ কমছে বিভিন্ন বয়সি মানুষদের তা ধারনার অতীত। মধ্য বয়সি পুরুষের চেয়ে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষতি ভয়ানক বেশী। কিন্তু সাধারণ বায়ু দূষণের পাশাপাশি ন্যানো প্লাস্টিকের প্যাথোজেন ক্যারি করা এবং তার যেকোন অবস্থায় চামড়া ভেদ করে শরীরে ঢুকে যাবার ক্ষমতা কিংবা নিঃশ্বাসের সাথে ব্লাড ব্রেইন ব্যারিয়ারে গিয়ে আঘাত করার ক্ষমতা সত্যিই আতংকজনক। নতুন করে হাজারটা শারীরিক, মানসিক সমস্যা আসতে যাচ্ছে। যার খুব সাম্প্রতিক প্রমান হল ভীষণ বেড়ে যাওয়া অটিজম।
এখন যারা আমাদের নগরের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তারা হয়তো না জেনেই বা এত স্পষ্ট ধারনা না থাকায় এই ভয়াবহ প্রচার পদ্ধতির ভেতর ছিলেন। আশাকরি তারা তথ্যগুলো জানবেন এবং ভবিষ্যতে যেই মেয়র ও কমিশনার হবেন না কেন সঠিক বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি সুন্দর, নিরাপদ নগর ও নিরাপদ দেশ গঠনে অবদান রাখবেন।
পাশাপাশি ২০০২ সালের পলিথিন নিষিদ্ধকরণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, পলিথিনের বিকল্প গবেষনা, তৈরিতে সহায়তা, সাবসিডি ও ইনসেনটিভ ম্যাকানিজমের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তা ও ভোক্তাদের সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহনে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা প্রনয়নের দাবি জানাই।
মাহবুব সুমন
Researcher at National Energy and Environment Research Associates,Bangladesh (NEERA)

কোন মন্তব্য নেই