একবিংশ শতাব্দীতে চিন্তায় মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং 'ক্রসফায়ার'(!)
এক
'ট্রিগার হ্যাপি' অর্থাৎ 'হত্যাই অপরাধ দমনের একমাত্র উপায়' এই সংস্কৃতির বিকাশের এক স্বর্ণযুগ চলছে বর্তমান বাংলাদেশে। পরিষ্কার ভাবে বললে 'এনকাউন্টার' 'ক্রসফায়ার' 'বন্দুকযুদ্ধ' তথা বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডকেই বোঝায়।বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণ রোধ,দমনে গত মঙ্গলবার (১৪ই জানুয়ারি ২০২০) জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় কয়েকজন সাংসদ ধর্ষণকারীদের 'ক্রসফায়ারে' বা গুলি করে হত্যা করার দাবী জানান।
জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংসদ কাজী ফিরোজ বলেন,"এই মুহূর্তে সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করতে হলে এনকাউন্টার মাস্ট"(বন্দুকযুদ্ধে হত্যা জরুরি) ধর্ষককে গুলি করে হত্যা করতে হবে। একমাত্র ওষুধ ধর্ষককে গুলি করে হত্যা করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, "ধর্ষণকারী ধরা পড়েছে,ওই ছাত্রী তাকে শনাক্ত করেছেন। ধর্ষক পুলিশের কাছে আছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারা হোক।"
জাপার আরেক সাংসদ মুজিবুল হক বলেন, "মাদকের জন্য এত ক্রসফায়ার হচ্ছে, সমানে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়, ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনায় কেন একটা বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় নাই, তা আমি জানিনা।
জাপার এই সাংসদের বক্তব্যকে সমর্থন করেন একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা বিচক্ষণ রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং বর্ষীয়াণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ। আরেক কাঠি সরেস হয়ে তরীকত ফেডারেশনের সাংসদ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি বলেন, "আমি টুপি-দাড়ি নিয়ে, আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে বলছি, এদের (ধর্ষকদের) ক্রসফায়ার করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে, কোনো অসুবিধা নেই। "
সুক্ষ্ম প্রশ্ন জাগে, জনাব নজিবুল বশর যে বক্তব্য দেন তা ইসলাম সমর্থন করে কি না? বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে কি(!) কুরআন শরীফ কিংবা হাদিস শরীফে এমন কিছু বলা আছে কি?
সত্যিই আশ্চর্য লাগে সাম্য,সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদার অঙ্গিকার নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয় তার উনপঞ্চাশ বছরেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমর্থনকারী ব্যক্তিগণ সাংসদ হয়ে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেন খোদ সংসদে দাঁড়িয়েই (হায় সেলুকাস)।
এই প্রথম জাতীয় সংসদে ক্রসফায়ারে কথিত অপরাধীকে হত্যার পক্ষে বলা হল, তা নয়। ২০১৬ সালে একই ধরনের দাবী করেছিলেন কাজী ফিরোজ রশীদ। ২৭ সেপ্টেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের বিচারের আওতায় না নিয়ে ক্রসফায়ারে গুলি করে মেরে ফেলার দাবী করেছিলেন তিনি। ওই সময়ে এই বক্তব্যের জবাবে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেছিলেন, "This government does not believe in crossfire" (প্রথম আলো,২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬)
কিন্তু সরকার ক্রসফায়ারে আদৌ বিশ্বাস করে কি না তা এক গোলক ধাঁধা ও জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন করে আমাদের। কারণ ২০১৫ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছিলেন ১৮৬ জন, ২০১৬ সালে ১৭৮ জন। এমনকি চলমান মাদক বিরোধী অভিজানে ৫৮৫ দিনে নিহত হয়েছেন ৪৮৪ জন। এরমধ্যে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ২২০ জন, র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১২৯ জন,বিজিবির সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৪৯ জন নিহত হয়েছেন।
যদিও পুলিশের ভাষ্যমতে আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি ছুঁড়েন(!) গত দশবছরে দেশে কমপক্ষে ১'হাজার ৯২১ জন এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এ সরকার ২০০৮ নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় গেলে তারা বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করবে। পরবর্তী ২০১৪, ২০১৮ নির্বাচনী ইশতেহারে এমন কোন প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ দেয়নি। একটি রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র তথা সংসদে দাঁড়িয়ে আইন প্রণেতারা যখন এমন অর্বাচীন, স্থুল, জ্ঞানহীন বক্তব্য ও আচরণ প্রকাশ করেন তখন তা উদ্বেগজনক, ভীতি সৃষ্টি করে। আনুষ্ঠানিক ভাবে সংবিধান ও আইনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন।
অথচ একজন সাংসদের কাজ জনগনের স্বার্থ,অধিকার সুরক্ষায় আইন প্রনয়ণ করা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করা, সঠিক আইন প্রনয়ণ ও সংবিধানকে প্রাধান্য দেয়া।
বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে যে, "সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী (২৭ অনুচ্ছেদ)।"
আরোও বলা হয়েছে যে,"আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভে যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যাক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা যাইবেনা, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে (৩১ অনুচ্ছেদ)।"
"আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না (৩২ অনুচ্ছেদ)। "
এ থেকে বোঝা যায় চরমতম অপরাধী বা অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিও আইনের আশ্রয়লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভ সাংবিধানিক অধিকার। এই সংবিধানকে সমুন্নত রাখাই সাংসদের কাজ। প্রজাতন্ত্র বা রিপাবলিক (Republic) যে অন্য ব্যবস্থাগুলো থেকে ভিন্ন হয়ে উঠল তার কারণ হচ্ছে, আইনের চোখে নাগরিকের সমতা, সবার বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করে।আর রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস বলে যে এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই আইন ও বিচার বিভাগের উদ্ভব হয়েছে।
শুধু ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তি নয়, যেকোন অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা নাগরিকের ন্যায়বিচার লাভের নিশ্চয়তার অধিকার রয়েছে। যে ব্যবস্থা নাগরিকের ন্যায়বিচার লাভের নিশ্চয়তা দেয় না, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয় না তা কেবল বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই তুলে ধরে না সাথে সাথে রাষ্ট্র ও ব্যক্তিকে অসহিষ্ণু ও প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলে।
রাষ্ট্রের নাগরিকদের জনপ্রতিনিধি হয়ে মহান সংসদে সাংসদরা যখন এমন উদ্ভট বক্তব্য ও বক্তব্যের সমর্থন পান তখন দেশের আইনের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হুমকি ও প্রশ্নের মুখে পড়ে। রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার অসহায়ত্ব, আইনের অপপ্রয়োগ প্রকাশ পায়। যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নয়।
দুই
-----
কোন কিছু ঘটে যাওয়া মাত্রই, দেখা মাত্রই আমরা সংবেদনশীল মানুষ হিশেবে খানিক চিৎকার, প্রতিবাদ করি কিন্তু বিচক্ষণতার পরিচয় না দিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হই। এমনকি অনলাইন মাধ্যমগুলোতে বিচারিক আদালত, ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ আইনকে একহাত দেখে নেয়ার ধৃষ্টতা দেখাই। এটাই আমাদের স্বভাবে পরিণত হচ্ছে। আর ফেসবুকের কল্যাণে এটাই শাশ্বত, স্বাভাবিক ও হিট।
কিন্তু মানুষ ঠিক কোনখানে অন্যান্য জীব থেকে আলাদা, মানুষে-মানুষে পার্থক্য তা একবারও ভাববার প্রয়োজন বোধ করিনা। অন্যায়-অত্যাচার-অপরাধের প্রতিবাদ সততই সুন্দর, স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া কিন্তু প্রতিবাদে জ্ঞান-প্রজ্ঞা-বিবেচনা-অভিজ্ঞতা-সততা না থাকলে সময়ের সাথে সাথে বেলুনের মতো চুপসে যায়। সমাজের চলমান নানা অসংগতি যেমন হত্যা-খুন-ধর্ষণ সহ নানা নৃশংসতার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মূহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। আর এই বিষয় গুলো নিয়েই ক্ষুব্ধ মানুষ নিজস্ব মতামত, বিচার বিশ্লেষণ করে থাকেন। এমনকি তীব্র প্রতিক্রিয়াও আমরা সামাজিক মাধ্যম গুলোয় দেখেছি। এটা তো খুবই ভাল দিক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা এই সুযোগে বুঝে-না বুঝে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার অপরাধের শাস্তি নিজেরাই দিয়ে ফেলি। আমাদের ওয়াকিবহাল থাকা জরুরী যে, ধর্ষণ-খুন-চুরি-হত্যা সহ বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আদালতে প্রমাণিত অপরাধীর শাস্তি কি হবে তা রাষ্ট্রীয় আইনে উল্লেখ থাকে। সর্বোচ্চ শাস্তি 'মৃত্যুদন্ড' সংবিধানে বা আইনে উল্লেখ থাকলে সে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়াও রাষ্ট্রীয় আইনে উল্লেখ থাকে। একজন বিচারকেরও ক্ষমতা নেই সেই আইনের বাইরে যাওয়ার। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালত কর্তৃক প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে 'অপরাধী' বলা অন্যায়। বিশেষত ধর্ষণে ভিক্টিমের পরিচয় যেমন গোপন রাখা জরুরী তেমনি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালত কর্তৃক প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তার নিজের পরিচয়,পরিবার, ব্যক্তিগত তথ্যগুলো গোপন রাখাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা যারা, অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারে প্রমাণিত হওয়ার আগেই ফাঁসি, মৃত্যুদণ্ড, লিঙ্গ কর্তন, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, গণপিটুনি, হত্যা কিংবা মধ্যযুগীয় বর্বরতা’র কথা বলেন, দাবী তোলেন তা সম্পূর্ণ আইন ও সংবিধান পরিপন্থী এমনকি এ ধরনের খুলখাল্লাম দাবী সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহ মূলক অপরাধ করেছেন বলা যায়। এসব বর্বরতার সাফাই গাইতে গিয়ে আপনারা যুক্তি দেন অপরাধী আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যায়, বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিগ্রস্থ রাষ্ট্রে বিচার প্রক্রিয়া অনেকাংশে নির্ভর করে টাকা ও ক্ষমতার ওপর। আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে খুব সহজেই রাষ্ট্র বা ব্যক্তি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে নিজ স্বার্থে গুম-খুন-হত্যা করার সুযোগ পায়।
কার্যতই বলে রাখা ভালো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণে দ্রুত অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেফতার ও বিচার শুরু হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র আদতে মধ্যবিত্ত হলেও সংস্কৃতি এলিট শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে।' অন্যদিকে একই ক্যাম্পাসের চা-বিক্রেতা স্বপন মামা তার মেয়ের ধর্ষণের বিচারের দাবীতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে। যারা বিচারহীনতার সংস্কৃতির স্বপক্ষে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে অবস্থান নেন আপনাদের কারুর ধর্ষণ, রাষ্ট্রীয় আইন, বিচার-প্রক্রিয়া, অপরাধ বিজ্ঞান, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা, জ্ঞানবোধ নেই। আপনাদের বোধশক্তি(আই কিউ) হয়তো একটি শিম্পাঞ্জির চেয়েও কম।
কোন অপরাধীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় তখনই যখন আপনার আইন, রাষ্ট্র, সমাজ-ব্যবস্থা অপরাধীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। অপরাধী নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে প্রচলিত রাষ্ট্র কাঠামোয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে সংশোধনমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হয়, দৃষ্টান্তমূলক নয়। একজন অপরাধীকে মেরে ফেললে তাকে তার কৃতকর্মের জন্য অপরাধবোধ উপলব্ধি করতে, অনুতপ্ত, সংশোধন হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয় যা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা ও জেলখানার আসল উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করে। মনে রাখতে হবে আইনের শাসন ও সরকার এ দুটি বিষয়ের নিজস্ব চলার গতি আছে। একটি অপরটির উপর হস্তক্ষেপ বা বাধার সৃষ্টি করলে আইন নাগরিকের সমতার ধারণাকে অস্বীকার করলে তা আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। একারণেই "সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় ৭০ বারের মত পিছিয়ে যায়।" "তনুকে ভাল্লুকে খেয়েছে বলে ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসে" এবং "আব্বু তুমি কানতেছো যে" এর মতো আর্তচিৎকার বারবার কানে প্রতিধ্বনিত হয়। যা আধুনিক কল্যাণকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নয়। তাই কথা বলতে হবে প্রচলিত আইন ও কাঠামো পরিবর্তনের জন্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের স্বপক্ষে নয়।
মানবাধিকার আইনের কথা শুনলেই যাদের গায়ে ফোসকা পড়ে, পশ্চাতদেশে জ্বালাপোড়া করে, মানবাধিকারের কথা কেউ বললে তাকে চড়ান শুলে আপনারা আর কিছু ধরতে না পারেন ধৈর্য্য ধরেন, জ্ঞান বৃদ্ধি করেন। মানবাধিকার আইন কারো কথায় চলেনা। মানবাধিকার আইন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের নির্ধারন করে দেয়া একটি সনদ। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর এটি খসড়া ভাবে প্রণীত হয়। যা পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গভাবে ৩০টি ধারায় বিশদ বর্ণনা ও উপযোগিতার কথা বলা আছে। আর আপনার রাষ্ট্র এই সকল ধারার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে, মানবাধিকার রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে সেই সনদে সাক্ষর করে এবং এটি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
তিন
বাংলাদেশে এসিড নিক্ষেপ দ্রুত কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে শাস্তি মৃত্যুদন্ডকে চিহ্নিত করেন কেউ কেউ। জেনে রাখা ভাল মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি এসিড নিয়ন্ত্রণ, বিপণন ও বাজারজাতকরণ সংক্রান্ত আইনও কড়াকড়ি ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। তাই এককভাবে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করায় এসিড নিক্ষেপ কমে গিয়েছিল বলাটা ভুল হবে।
যেকোন অপরাধের বিচার-শাস্তির পাশাপাশি অপরাধ নিবারন অর্থাৎ প্রজননক্ষেত্র অক্ষত রেখে শুধু শাস্তির ভিত্তিতে অপরাধ দমন করা যায় না। অপরাধের উৎসগুলোকে চিহ্নিত করে মূলোৎপাটন করাই উপযুক্ত ব্যবস্থা।
অনগ্রসর ও অপ্রতুল সম্পদের এবং শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া দেশেই ধর্ষণের প্রকোপ বেশি। ধর্মীয় গোঁড়ামি, অবাধ ইন্টারনেট ব্যবহার, নারী শিক্ষার অনগ্রসরতা, নারীকে পুঁজির পণ্যায়ন, নারীকে ভোগপণ্য হিসেবে প্রচার করা, মানসিক চিন্তা, পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনে আবহমান কালের সংস্কৃতির অবক্ষয় ও বিকৃত রূপলাভ, মাদকের প্রকোপ, যৌন অবদমনসহ অনেক কারণেই ধর্ষণবান্ধব ও অন্যান্য অপরাধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই ঘটনা ঘটার পর বা ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পর বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে জ্ঞানহীন কথা, উদ্ভট সিদ্ধান্ত, খুলখাল্লাম মতামত না দিয়ে সমস্যার গভীরে মনোযোগ দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধীর মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে গবেষণা, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, সামাজিক অবক্ষয় রোধ, সুস্থ অর্থনীতি, স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ, বিশেষত নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা, পাঠ্যসূচীর পরিবর্তনের মাধ্যমে ধর্ষণ সহ অন্যান্য জঘন্যতম অপরাধ রোধ বা কমিয়ে আনা সম্ভব।
পরিশেষে,
ধর্ষককে বা অপরাধীকে যদি রাষ্ট্রীয় আইনে সর্বোচ্চ সাজা 'মৃত্যুদন্ড' দিতেই হয় তবে তা করতে হবে সঠিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রয়োজনে বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয় সংস্কার, সংশোধন, পরিমার্জন সম্পন্ন করতে হবে।
বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিগ্রস্থ রাষ্ট্রে বিচার প্রক্রিয়া অনেকাংশে নির্ভর করে টাকা ও ক্ষমতার ওপর। আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে খুব সহজেই রাষ্ট্র বা ব্যক্তি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে নিজ স্বার্থে গুম-খুন-হত্যা করার সুযোগ পায়।
কার্যতই বলে রাখা ভালো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণে দ্রুত অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেফতার ও বিচার শুরু হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র আদতে মধ্যবিত্ত হলেও সংস্কৃতি এলিট শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে।' অন্যদিকে একই ক্যাম্পাসের চা-বিক্রেতা স্বপন মামা তার মেয়ের ধর্ষণের বিচারের দাবীতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে। যারা বিচারহীনতার সংস্কৃতির স্বপক্ষে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে অবস্থান নেন আপনাদের কারুর ধর্ষণ, রাষ্ট্রীয় আইন, বিচার-প্রক্রিয়া, অপরাধ বিজ্ঞান, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা, জ্ঞানবোধ নেই। আপনাদের বোধশক্তি(আই কিউ) হয়তো একটি শিম্পাঞ্জির চেয়েও কম।
কোন অপরাধীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় তখনই যখন আপনার আইন, রাষ্ট্র, সমাজ-ব্যবস্থা অপরাধীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। অপরাধী নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে প্রচলিত রাষ্ট্র কাঠামোয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে সংশোধনমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হয়, দৃষ্টান্তমূলক নয়। একজন অপরাধীকে মেরে ফেললে তাকে তার কৃতকর্মের জন্য অপরাধবোধ উপলব্ধি করতে, অনুতপ্ত, সংশোধন হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয় যা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা ও জেলখানার আসল উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করে। মনে রাখতে হবে আইনের শাসন ও সরকার এ দুটি বিষয়ের নিজস্ব চলার গতি আছে। একটি অপরটির উপর হস্তক্ষেপ বা বাধার সৃষ্টি করলে আইন নাগরিকের সমতার ধারণাকে অস্বীকার করলে তা আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। একারণেই "সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় ৭০ বারের মত পিছিয়ে যায়।" "তনুকে ভাল্লুকে খেয়েছে বলে ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসে" এবং "আব্বু তুমি কানতেছো যে" এর মতো আর্তচিৎকার বারবার কানে প্রতিধ্বনিত হয়। যা আধুনিক কল্যাণকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নয়। তাই কথা বলতে হবে প্রচলিত আইন ও কাঠামো পরিবর্তনের জন্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের স্বপক্ষে নয়।
মানবাধিকার আইনের কথা শুনলেই যাদের গায়ে ফোসকা পড়ে, পশ্চাতদেশে জ্বালাপোড়া করে, মানবাধিকারের কথা কেউ বললে তাকে চড়ান শুলে আপনারা আর কিছু ধরতে না পারেন ধৈর্য্য ধরেন, জ্ঞান বৃদ্ধি করেন। মানবাধিকার আইন কারো কথায় চলেনা। মানবাধিকার আইন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের নির্ধারন করে দেয়া একটি সনদ। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর এটি খসড়া ভাবে প্রণীত হয়। যা পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গভাবে ৩০টি ধারায় বিশদ বর্ণনা ও উপযোগিতার কথা বলা আছে। আর আপনার রাষ্ট্র এই সকল ধারার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে, মানবাধিকার রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে সেই সনদে সাক্ষর করে এবং এটি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
তিন
'মৃত্যুদন্ড' বা কড়া শাস্তি প্রয়োগ করলে শাস্তির ভয়ে কেউ আর সে অপরাধ করেন না বা করতে সাহস পান না বলে অনেকে মত দেন। লক্ষ্য করলে দেখবেন সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় খুনের অপরাধে। মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অপরাধ কমানো গেলে দেশে অনেকাংশে খুন-হত্যা কমে যাওয়ার কথা ছিল। তা কমে গেছে কি না আপনাদের কাছেই আমার প্রশ্ন (?)
বাংলাদেশে এসিড নিক্ষেপ দ্রুত কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে শাস্তি মৃত্যুদন্ডকে চিহ্নিত করেন কেউ কেউ। জেনে রাখা ভাল মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি এসিড নিয়ন্ত্রণ, বিপণন ও বাজারজাতকরণ সংক্রান্ত আইনও কড়াকড়ি ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। তাই এককভাবে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করায় এসিড নিক্ষেপ কমে গিয়েছিল বলাটা ভুল হবে।
যেকোন অপরাধের বিচার-শাস্তির পাশাপাশি অপরাধ নিবারন অর্থাৎ প্রজননক্ষেত্র অক্ষত রেখে শুধু শাস্তির ভিত্তিতে অপরাধ দমন করা যায় না। অপরাধের উৎসগুলোকে চিহ্নিত করে মূলোৎপাটন করাই উপযুক্ত ব্যবস্থা।
অনগ্রসর ও অপ্রতুল সম্পদের এবং শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া দেশেই ধর্ষণের প্রকোপ বেশি। ধর্মীয় গোঁড়ামি, অবাধ ইন্টারনেট ব্যবহার, নারী শিক্ষার অনগ্রসরতা, নারীকে পুঁজির পণ্যায়ন, নারীকে ভোগপণ্য হিসেবে প্রচার করা, মানসিক চিন্তা, পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনে আবহমান কালের সংস্কৃতির অবক্ষয় ও বিকৃত রূপলাভ, মাদকের প্রকোপ, যৌন অবদমনসহ অনেক কারণেই ধর্ষণবান্ধব ও অন্যান্য অপরাধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই ঘটনা ঘটার পর বা ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পর বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে জ্ঞানহীন কথা, উদ্ভট সিদ্ধান্ত, খুলখাল্লাম মতামত না দিয়ে সমস্যার গভীরে মনোযোগ দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধীর মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে গবেষণা, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, সামাজিক অবক্ষয় রোধ, সুস্থ অর্থনীতি, স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ, বিশেষত নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা, পাঠ্যসূচীর পরিবর্তনের মাধ্যমে ধর্ষণ সহ অন্যান্য জঘন্যতম অপরাধ রোধ বা কমিয়ে আনা সম্ভব।
পরিশেষে,
ধর্ষককে বা অপরাধীকে যদি রাষ্ট্রীয় আইনে সর্বোচ্চ সাজা 'মৃত্যুদন্ড' দিতেই হয় তবে তা করতে হবে সঠিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রয়োজনে বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয় সংস্কার, সংশোধন, পরিমার্জন সম্পন্ন করতে হবে।
আব্দুল্লাহ্ - আল মামুন
সম্পাদক,হুল
www.hullmag.blogspot.com
Post a Comment