ছাত্রসংগঠন গুলোর ঐক্যের ডাক এবং কতিপয় সংকট

গত দুইদিন আমি ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর  এবং অন্যান্য আহতদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখতে গিয়ে নুরুল হক নুরের মুখ থেকে সবচেয়ে বেশি যে কথাটি শুনেছি তা হল,আসেন ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াই। ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতিকে এমনকি এক্টিভিটিস্টদেরও ঐক্যের আহ্বান জানাতে শুনেছি।এই ঐক্যের দাবী জনগনেরও। কিন্তু কোন ঐক্য কার্যত চোখে পড়ছে না। আমি নিজেও অনেক ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে অনুরোধ করেছি অন্তত শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়ে তুলতে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন, যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন,জাবিতে দূর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন  থেকে আমি যা শিখেছি তা হল জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকেই নিপীড়ক শক্তি ভয় পায় এমনকি যারা নিপীড়নের বিরোধিতা করেন তারাও ভয় পান। কারণটাও মজার,প্রগতিশীল ঘরানার ছাত্র সংগঠন গুলো আকারে ছোট আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন গুলো গড়ে উঠছে সেগুলো বিশাল শক্তি নিয়েই সামনে আসে ফলে ছোট ছোট সংগঠন গুলো তাদের পরিচয় সংকটে ভোগে। কেউ কেউ ফায়দা খোঁজেন। আবার খুব কম সংখ্যক সংগঠন আন্দোলনের গুরুত্ব অনুধাবনও করে। ছাত্র রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতি সবখানেই জনগন সকলের বৃহত্তর ঐক্য চায়। এমনকি রাজনৈতিক সংঠন গুলোও বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলে আসছে। কিন্তু এতোদিনেও কেন ঐক্য হচ্ছেনা? এই প্রশ্নের উত্তর আমার একার পক্ষে দেওয়া সম্ভাব না। তবে অনুসন্ধান চালানো যায়। প্রশ্ন তোলাও যায়। আসুন প্রথম প্রশ্ন তুলি, ঐক্য কেন হচ্ছে না?
যদি এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজতে যাই তাহলে প্রথম যে জিনিসটা সামনে আসবে যে ঐক্য কিসের ভিত্তিতে হবে?
যে কোন রাজনৈতিক ঐক্য নির্দিষ্ট  কিছু শর্তের ভিত্তিতে হয়। যেমন নির্বাচন কে কেন্দ্র করে ঐক্য হতে পারে।ক্ষমতায় যাওয়া,আসন বন্টন ইত্যাদি বিষয়ে রাজনৈতিক সংগঠন গুলো নির্বাচন  কেন্দ্রীক ঐক্য গড়ে তোলেন। এধরণের ঐক্য বাংলাদেশে নতুন নয়।
আন্দোলন কেন্দ্রিক ঐক্য। বিভিন্ন আন্দোলনের সময় এ ধরনের ঐক্য চোখে পড়ে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এ ধরনের ঐক্য হয়েছিল।
এছাড়াও নীতি বা আদর্শের  ভিত্তিতেও ঐক্য হতে পারে যেমন,বাম গণতান্ত্রিক জোট, প্রগতিশীল ছাত্রজোট,ইসলামী ঐক্যজোট।
এ তো গেল ঐক্য কেন হতে পারে তার অনুসন্ধান কিন্তু আমাদের প্রশ্ন ছিল ঐক্য কেন হচ্ছেনা? সমস্যাটা কোথায়?
এই প্রশ্নের উত্তর অনেকগুলো,আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সাথে ঐক্যের প্রশ্নে কথা বলে যা বুঝতে পেরেছি তা হল ঐক্যের প্রশ্নে একটা মূল বাধা হল সাংগঠনিক সংকির্ণ    দৃষ্টিভঙ্গি। কিরকম? ভিপি নুরের ওপর হামলার কারণের দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে  যে সন্ত্রাস বিরোধী  ঐক্যের আকাঙ্খা প্রকাশ পেয়েছে, তাতে সাড়া না দেওয়ার কারণ হিসেবে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মত গুলো আমি নিচে পয়েন্ট আকারে বলছি,
★নুরের সাথে আগেও ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টায় নুর সাড়া দেয়নি।
★তাদের সাংগঠনিক অবস্থান পরিষ্কার না।
★এরা ছাত্রলীগ হতে আলাদা না, ঘুরেফিরে একই।(স্বাধীনতার সংগ্রামকেও দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি বলে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্তদের কাছথেকেও ইনারা শিক্ষা নেন না)
★এখন নুরেরা ঐক্য চায় রাজনৈতিক ভাবে স্ট্যাবলিশ হওয়ার জন্য।(নুর এবং তার সংগঠন নিজেদের হেডমেই মার খেয়ে রাজনীতিতে এসেছেন)
★নুরেদের আদর্শ নেই।(বিমূর্ত যে আদর্শের কথা আপনারা মেনশন করছেন তা কেন সবার থাকতে হবে?আর নুর যদি আপনাদের আদর্শ নিয়েই রাজনীতি করবে তাহলে আপনারাই আজ তার জায়গায় থাকতেন)
★সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ নিজেদের পক্ষ থেকে বসার উদ্যোগ নিচ্ছে না।
★ছাত্রদলের সাথে ঐক্য করলে তাদের রাজনৈতিক পূনর্বাসন করা হবে।(ছাত্রদলকে অজুহাত হিসেবে টেনে কি ফ্যাসিজমকেই সাহায্য করা হচ্ছে না?)
★তারা বিপ্লবী আদর্শের  না!(আপনারা বিপ্লবী আদর্শের  হয়েও এদ্দিনে নুর হয়ে উঠতে পারেন নাই কেন?)
এসব বলে ঐক্য প্রক্রিয়াকে ধীর করে ফেলা হয়েছে। আমি আমার বোধ-বুদ্ধি থেকে বলতে পারি ঐক্য না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে সাংগঠনিক সংকির্ণতা। নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে ভোগা। নুর বার বার নিজেকে সাধারণ ছাত্রদের পক্ষের নেতা হিসেবে পরীক্ষা দিয়েছে। এর ফলেই তার গ্রহনযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। নয় নয়বার হামলার পড়েও বিরুদ্ধতা চালিয়ে গেছে এটা প্রত্যেককে স্বীকার করতে হবে। হামলার ঘটনা আগেও ঘটেছে কিন্তু সারা দেশের মানুষ এতো উদ্বেলিত হয়নাই এটাকে ঈর্ষা না করে বরং সাধারণ মানুষের আবেগকে গুরুত্ব দিন। কোন বইয়ের তত্ত্ব এখানে বিপ্লব ঘটাবে না বরং এখানে যদি কিছু হয়ই তবে তা গড়ে উঠবে আপামর সাধারণ মানুষে আবেগ, ভালবাসা,রাগ-ক্ষোভকেই কেন্দ্র করে। নিজেদের সাংগঠনিক স্বার্থ,রিক্রুটমেন্ট এর হিসাব ইত্যাদি প্রশ্নকে এই মুহূর্তে গৌণ করে দেখে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ছাত্র রাজনীতি কিংবা জাতীয় রাজনীতিতে নিপীড়ন, অত্যাচার, হামলা-মামলা,গুম-খুনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যে ফ্যাসিবাদী কাঠামো সবার উপর আক্রমণ করছে তাকে রুখে দিতে এই মুহূর্তে জাত পাত ভাবলে চলবে না। নুর আগে ঐক্যে আসেনি জন্যে আজকে আপনারা নুরের জন্য দাঁড়াবেন না, লড়বেন না কালকে আবার আপনি আক্রান্ত হবেন তখন আপনার পাশেও কেউ দাঁড়াবে না। আজ আপনি দাঁড়ান, ঐক্যের সংস্কৃতি গড়ে তুলেন কালকে আপনাকে আর বলতে হবে না।  নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তি একখানে করতে হলে আগে থেকেই শর্ত জুড়ে দেওয়া বন্ধ করেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কিংবা সাধারণ জনগনের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন সিদ্ধান্তে ঘটান দেখবেন জনগনের মধ্যে গ্রহনযোগ্যতা তৈরি হচ্ছে,স্পেস তৈরি হচ্ছে। দুজন কেন্দ্রীয় নেতা গিয়ে সংহতি জানিয়ে যে ঐক্য তাতে  কাজের কাজ কিছুই হবেনা নিজের কর্মীদের নিয়ে মিছিলে-শ্লোগানে উপস্থিত থাকতে হবে। নিজেরাই গণমূখী হয়ে উঠে এই ফ্যাসিজমকে প্রতিহত করা সম্ভব।


লেখকঃ
জাফর মুহাম্মদ
  

কোন মন্তব্য নেই