অতিথি পাখিরা কি অতিথির মর্যাদা পায়?

 প্রাণী জগতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাখিরা। কবি বাল্মীকি এক বিরহাতুর পাখিকে দেখেই শ্লোকগুলি লিখেছিলেন। এটিই নাকি আদি কবিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বার বার এসেছে পাখির কথা। পার্সি বিসি শেলির ‘টু এ স্কাইলার্ক’ বা জন কিটসের ‘ওড টু নাইটিঙ্গেল’-এর বিষয়ই পাখি।কিন্তু কাব্যের জগত আর বাস্তব এক নয়। কাব্যে আদরণীয় অনেক পাখিই আজ বিপন্ন। পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক প্রজাতির পাখি। বিশাল পাখির সাম্রাজ্যে এমন বেশ কয়েকটি শ্রেণির পাখি আছে, যারা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অন্য জায়গায় পাড়ি দেয়। বাংলাদেশে শীতকালে এমন কিছু পাখি দেখা যায় যা সচরাচর অন্য সময়ে দেখা যায় না।শীত মৌসুমে (এখানে মৌসুম বলতে দুমাসের একটি ঋতু না বুঝিয়ে ঐ ঋতুর প্রায় দুমাস আগে ও পরের সময়কে বুঝানো হয়েছে।)  হিমালয় পর্বতমালা এবং সুদূর সাইবেরিয়া থেকে,কদাচ উত্তর মেরু থেকেও কিছু পাখি আমাদের দেশে প্রতি বছর আসে এবং আবার ফিরে যায়।এই সংবার্ষিক আসা যাওয়াই হচ্ছে পাখির পরিব্রাজন,অভিপ্রায়ন বা মাইগ্রেশন।অভিপ্রায়ত পাখিকে আমরা বলি শীতের পাখি,অতিথি পাখি বা যাযাবর। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী শীতের পাখি আসে ভরা শীত মানে পৌষ ও মাঘে।উপরন্ত সব শীতের পাখি আসে সাইবেরিয়া থেকে।এই দুইটি ধারনা বহুলাংশে মিথ্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক(অবসর প্রাপ্ত) ডাঃ মোঃ আলী রেজা খান এর জরিপ মতে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা আসতে থাকে বাংলাদেশে। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি এই তিন মাসে দেশের সর্বত্র শীতের পাখি সর্বাধিক দেখা যায়। দেশে যত পাখি আসে তার ৮০ ভাগের উপর পাখি আসে হিমালয় পর্বত ও তার পাদদেশ থেকে।কেবল কিছু কিছু হাঁস এবং জিরিয়া আসে সাইবেরিয়া এবং উত্তর মেরু থেকে।ভারতের Bombay  Natural History Society র গবেষণা থেকে এই তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশের দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন, উপকূল, সিলেট অঞ্চলের হাকালুকি হাওর, টাংগুয়ার হাওড়, বাইক্কা বিল, ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ভোলা সহ বিভিন্ন উপকূলীয় বিভিন্ন জেলা আর চরগুলো অতিথি পাখির কোলাহলে মুখরিত থাকে।  

অতিথি পাখি কেন আসে কেন যায়ঃ 

শীতের শুরুতে হিমালয়ের তিন হাজার মিটার উচ্চতা থেকে এভারেস্ট পর্বতের চূড়া, সাইবেরিয়া এবং উত্তর মেরু এলাকায় দিনের তাপমাত্রা হ্রাস পায়,শীতের প্রচণ্ডতা বাড়ে,হ্রাস পায় দিনের আলোর পরিমান।সেই সাথে সকল খাদ্যবস্তু বরফের পুরো আবরণে ঢাকা পড়ে।ফলে পাখিরা উত্তর মেরু ও সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিনে,হিমালয়ের উঁচু এলাকা থেকে নিচু এলাকা,পাদদেশ বা দক্ষিনের সমভুমি এলাকায় নেমে আসে ঐ সব প্রতিকুল অবস্থা থেকে আত্মরক্ষার জন্য। উত্তরের পাহাড়ের চূড়ায় যখন প্রতিকুল আবহাওয়া ও পরিবেশ তখন দক্ষিনের প্রকৃতি মোটেও রুদ্র নয়।সেখানে তখনো ১১ ঘন্টায় দিন।সবে বর্ষার পানি সরে গিয়ে কাদায় গজাচ্ছে নতুন উদ্ভিদ,পোকা মাকড় ও কীট পতঙ্গ।এসব খাবার ও বন্ধুসুলভ পরিবেশ ব্যবহারের জন্য চলে সাংবার্ষিক আসা যাওয়া,যা আজও চলছে। আমাদের দেশে দু'দলের শীতের পাখি আসে।এদের এক দল কেবল এদেশেই আসে এবং এখান থেকেই ফিরে যায়।অন্য দল বাংলাদেশ থেকে আরো দক্ষিনে যায়।এদেশ থেকে ফিরে যাবার জন্য শীতের পাখিদের দেহে কিছু বাহ্যিক এবং কিছু অভ্যন্তরীণ উদ্দীপক কাজ করে।প্রথম উদ্দীপক হচ্ছে চামড়ার নিচে খুব পুরু হয়ে জমে উঠা চর্বি।দ্বিতীয় হচ্ছে আবহাওয়াগত যেমন দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, দৈনিক গড় তাপমাত্রা এবং বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমান। পাখি বিশারদ ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক বলেন, 'দেশি-বিদেশি নয়, যে পাখি একদিন এদেশে দেখা যায়, সেটাও এদেশের পাখি৷ কিছু পাখি এ দেশে সারা বছর থাকে, কিছু থাকে না৷ পাখি এরকমই হয়৷ পাখির খাবার সারা বছর এক মহাদেশেও হয় না৷ কিছু পাখি আছে গ্রীষ্মে বা শীতে খাবারের জন্য একেক জায়গায় থাকে৷ আবার প্রজননের জন্য আলাদা জায়গায় থাকে৷ তাহলে কোন পাখি কোন দেশের? সারা বিশ্ব যেটি মেনে নেয়, সেটি হলো, পাখিরা একদিনের জন্য যে দেশকে নিয়মিত ব্যবহার করে, পাখিরা সেই দেশের৷ এক পাখি বহু দেশের হতে পারে৷ যেমন ধরেন, সুমচাও নামের পাখি গ্রীষ্মে বাংলাদেশে জন্মায়, শীতে তাদের কিন্তু খাবার নেই, তাই তারা দক্ষিণে, যেমন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় চলে যায়৷ আবার তারা গ্রীষ্মে এই দেশে ফিরে আসে৷ এই পাখি তাহলে কোন দেশের? এটা বাংলাদেশেরও, মালয়েশিয়ারও৷ আবার অনেক পাখি আছে যারা শীতে বাংলাদেশে আসে৷ এরপর প্রজননের জন্য হিমালয়ে চলে যায়, তিব্বতে চলে যায় বা তুন্দ্রা অঞ্চলে চলে যায়৷ তারা কি তাহলে বাংলাদেশের পাখি নয়? অবশ্যই বাংলাদেশের পাখি৷ ওরা সাইবেরিয়ারও পাখি৷ এই হিসেবে আমাদের যে ৭০০ প্রজাতির পাখি আছে, এর মধ্যে সাড়ে ৩শ' প্রজাতির পাখি সারা বছর বাংলাদেশে থাকে না৷' 

বিশ্ব অতিথি পাখি দিবসঃ 

এই পাখিদের আবাস নিরাপদ রাখতে ও বিচরণ স্বাভাবিক রাখতে প্রত্যেক বছরের ১১ মে দিনটি "বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস" হিসেবে পালন করা হয়। ১১ মে-র কাছাকাছি সময়ে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা থেকে পাখিরা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দিকে উড়ে যায়। তাই এই দিনটিকে ‘বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে এই উদ্যোগ। ২০০৬ থেকে দিনটি পালন করা হচ্ছে। 




বাংলাদেশে কত অতিথি পাখি আসেঃ 


প্রায় ৩শ' প্রজাতির পাখি শীতে বাংলাদেশে থাকে, কিন্তু প্রজনন করে না৷ প্রজননের সময় হলো উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্ম৷ তখন তারা উত্তরে চলে যায়৷ হিমালয়, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া বা আরো উত্তরে সাইবেরিয়ায় চলে যায়৷ আর ১০ থেকে ১২ প্রজাতির পাখি আছে, যারা গ্রীষ্মেই শুধু বাংলাদেশে থাকে, শীতে এখানে থাকে না, দক্ষিনে চলে যায়, যেখানে শীতেও কিছুটা আর্দ্র৷ আট থেকে নয় বছর আগেও বাংলাদেশে চার থেকে পাঁচ লক্ষ অতিথি পাখি আসতো। কিন্তু সেই সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। তবে বাংলাদেশে অতিথি হয়ে আসা ৩০০ প্রজাতির মধ্যে মাত্র ৮০ প্রজাতি জলাভূমি দাপিয়ে বেড়ায়। বাকি ২২০ প্রজাতির বিচরণ বনাঞ্চলে। তাই অতিথি পাখি মাত্রই হাওর কিংবা জলাশয়ে থাকবে এমন ধারণাটিও সঠিক নয়। এসব পাখিদের মধ্যে বাংলাদেশের অতি পরিচিতি অতিথি পাখি নর্দান পিনটেইল। এছাড়া স্বচ্ছ পানির বালি হাঁস, খয়রা চকাচকি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস পাখি, বড় সারস পাখি, হেরন, নিশাচর হেরন, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন পাখি, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচার্ড, বিলুপ্ত প্রায় প্যালাস ফিস ঈগল (বুলুয়া) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও নানা রং আর কণ্ঠ বৈচিত্র্যের পাখিদের মধ্যে রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, বালি হাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল, নীলশীর পিয়াং, চীনা, পান্তামুখি, রাঙামুড়ি, কালোহাঁস, রাজহাঁস, পেড়িভুতি, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি। 

কীভাবে অতিথি পাখি গোনা হয়ঃ 

আকাশে ডানা ঝাপটে বেড়ানো এই জীবদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত না করে তাদের সংখ্যা নিরূপণ করা বেশ কঠিন কাজ। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্যরা এই কঠিন কাজটিকে বেশ ভালোবাসেন। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে এই কয়েক মাস তারা ঘুরে বেড়ান জলাশয় থেকে জলাশয়ে। পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব যাতে না পড়ে এমন দূরত্ব থেকেই তাদের কাজ করতে হয়। পাখিদের মাথা গোনা থেকে শুরু করে ছবি তোলা, বৈজ্ঞানিক নাম সংগ্রহ করার পাশাপাশি প্রতিটি প্রজাতির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য নোট করে নেন দলের সদস্যরা। আর এভাবেই কয়েকটি জরিপের তথ্যকে গড় করে পাখির অনুকূল সংখ্যা নিরূপণ করা হয়। এ তো গেলো জলার পাখিদের গোনার গল্প, বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো পাখিদের সংখ্যা নিরূপণ করাও বেশ কঠিন। পাখিদেরকে কয়েক বছর ধরে লক্ষ করতে হয়। শব্দ শুনে, ডানার আকৃতি দেখে আলাদা করতে হয়। পাখিদের পায়ে রিং পরানো হয়, প্রযুক্তির কল্যাণে অতিথি পাখিদের সাথে জুড়ে দেওয়া যায় স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার, গতিপথ নিরূপণের পাশাপাশি তাদের খাদ্যাভ্যাস আর প্রজননের হাল-হকিকতের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও জানা যায় এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

অতিথি পাখি কমার কারনঃ

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই মূলত পাখি পরিযানের জন্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। আরডিআরএস (RDRS)বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশ সমন্বয়ক মামুনুর রশিদ বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতিথি পাখির সংখ্যা কমছে। তিনি বলেন, হিমালয়, সাইবেরিয়ান, নেপাল, জিনজিয়াং এবং মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা অব্যাহত বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছু প্রজাতির পাখির জন্য শীত মৌসুমেও ঐসব এলাকা বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। পাখি বিশেষজ্ঞ আব্দুস সালাম বলেন, জলাভূমি হ্রাস পাওয়ায় এবং জলাশয় থেকে অনেক প্রজাতির মিঠা পানির মাছ বিলুপ্ত হওয়ায় অতিথি পাখি আগমনের সংখ্যা কমছে। পথে পথে লম্বা সব মোবাইল আর ইলেকট্রিক টাওয়ার, পাখিদের পরিযানের চিহ্নগুলো ধ্বংস হয়ে যাবার ফলে পাখিদের পরিযানে সৃষ্টি হচ্ছে বাধা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলাশয়গুলো ভরাট হচ্ছে, গড়ে উঠছে মানুষের বাসস্থান আর কৃষিজমি। ইনাম আল হক বলেন, ‘এটা শুধু আমাদের দেশেরই সমস্যা নয়, সারা পৃথিবীর সমস্যা। সম্প্রতি ‘বিজ্ঞান’ নামক একটি জর্নালের মে সংখ্যার প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২৫ বছরে পৃথিবী থেকে ৮০ শতাংশ পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ শেষ হয়ে গেছে। তো ৮০ শতাংশ পোকা শেষ হয়ে গেলে পাখি কী খেয়ে বেঁচে থাকবে? মানুষ এবং পরিবেশের জন্য কীটনাশক অত্যন্ত বিষাক্ত। পতিত জমিকে প্রাকৃতিক অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা। কিছু ঘাস, কিছু লতাগুল্ম যে স্থানে রয়েছে সেখানেও তো পাখি থাকে। সেই পতিত জমিটুকুও তো নেই।’ 

বন্ধ্যাত্বের শিকার হচ্ছে পাখিরা? 
পৃথিবীতে মানুষ বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে, অল্প জমিতে বেশি ফলনের আশায় মানুষ ব্যবহার করছে রাসায়নিক সার আর কীটনাশক। কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক একদিকে যেমন পাখিদের খাদ্যসংকট তৈরি করছে, অন্যদিকে এসব ক্ষতিকারক দ্রব্য খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়ছে। ফলে পৃথিবী জুড়ে বিপুল সংখ্যক পাখির প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। আর এ পাখিরা শিকার হচ্ছে বন্ধ্যাত্বের। পরিযায়ী পাখিরা এই রাসায়নিক বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকির সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করছে। পাশাপাশি মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের ফলেও পাখিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রজননক্ষমতা হারাচ্ছে বলে গবেষকদের কাছে তথ্য রয়েছে। 

"বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের প্রভাব আর সব প্রাণীর মতো পাখির জীবন যাত্রায়ও প্রভাব ফেলছে"   

বাড়ছে অবৈধভাবে পাখি শিকার!
আইনের তোয়াক্কা না করেই অনেকেই অতিথি পাখি শিকার করে চলেছে। সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে পুলিশের নজরদারি থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসা অতিথি পাখিদের পড়তে হয় শিকারীদের কবলে। বিশেষ করে ভোলা সহ মাঝির চর, নেয়ামতপুর চর, চর ফ্যাশন, চর কুকড়ি-মুকড়িতে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, শিকারীরা ধান ক্ষেতগুলোতে নানা ধরনের রাসায়নিক বিষ প্রয়োগ করেই পাখিদের কাবু করে। পাশাপাশি আছে জালের মাধ্যমে পাতা ফাঁদ, যেগুলোতে খুব সহজেই পাখি ধরা পড়ে। শিকারকৃত পাখির একটি বড় অংশ বিক্রি হচ্ছে বাজারে। পাখিটিকে বিষ দিয়ে মারা হয়েছে কিনা এ কথা চিন্তা না করেই ৫০০-৬০০ টাকা দরে বিভিন্ন চর এলাকার বাজারে অতিথি পাখি কিনে নিচ্ছেন স্থানীয়রা। ডাক্তার আর বিষেশজ্ঞদের মতে, পাখি ধরার জন্যে যে বিষ ব্যবহৃত হচ্ছে তা মানবদেহেও বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। 

সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় পাওয়া তথ্যে বিশিষ্ট প্রাণিবিজ্ঞানী তপন কুমার দে বলেন, “প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে ৩০০ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক সামগ্রী মানুষের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি বছর আট মিলিয়ন (৮০ লাখ) টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদী-নালা হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়। “সমুদ্র সৈকতে আসা পাখির খাদ্য গ্রহণের সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে প্লাস্টিকের ছোট ছোট অংশ খাদ্যনালীতে চলে যায়। শুধু তাই নয়, পাখির ছোট বাচ্চাদের পেটে প্লাস্টিক কণা পেটে চলে যায় ও অকালে মারা যায়।” 

জা:বি: এর অতিথি পাখির সংখ্যা কমার কারনঃ 
অতিথি পাখির মেলাখ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের জলাশয় পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকে শীতের শুরু থেকেই। গাছপালায় ঢাকা সবুজ এ ক্যাম্পাসের বুকে আছে বেশ কয়েকটি জলাশয়। বেশ কয়েক বছর ধরে এ জলাশয়গুলোকেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিচ্ছে শীতের অতিথি পাখিরা। তাই অতিথি পাখি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেন একে অপরের পরিপূরক। প্রতিবছর ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে আসে অসংখ্য অতিথি পাখি। তবে দিন দিন পাখির আগমনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গবেষকেরা মনে করছেন, পাখিদের বিরক্ত করায় অতিষ্ঠ হয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ছে পাখিরা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাখিদের বিরক্ত না করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক ব্যানার, ফেস্টুন লাগানো হয়েছে। কিন্তু সেগুলো মানছে না কেউ। লেকের পাশের রাস্তা দিয়ে চলছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য উচ্চশব্দে মাইকিং, শোভাযাত্রার বাদ্য-বাজনা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বহিরাগতদের গাড়ি, মোটরসাইকেলের হর্নের বিকট শব্দ। এমনকি লেকের পাড়ে গাড়ি রেখে উচ্চশব্দে গান শুনতেও দেখা যায় দর্শনার্থীদের। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্টসংলগ্ন লেকটি পাখিশূন্য হয়ে পড়ছে।  

পরিযায়ী পাখি রক্ষায় সচেতনতাঃ 

রাবি ক্যাম্পাসে পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য করার ফলে উপযুক্ত একটি আবাসন তৈরি হয়েছে। এখানে পাখিদের কেউ বিরক্ত করে না। পাখিরা সময় হলেই চলে আসে ক্যাম্পাসে। বিশেষ করে তারা পাখি কলোনিতে বসবাস করতে খুবই স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এছাড়াও এখানে তাদের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার ও প্রজনন ব্যবস্থা। কিছু পাখি গাছে প্রজনন করে, কিছু পানিতে। পরিয়ায়ী পাখিরা ক্যম্পাসে আসতে শুরু করে অক্টোবরের দিকে তারা মার্চ পর্যন্ত থাকে। কালো মানিক জোড়, ধলা মানিক জোড়, সরালি পাখি বেশির ভাগ আসে। পাখিদের বসবাসের সুবিধার্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নানাভাবে সহায়তা করেছে। এ বছর প্রথমবারের মত জল ময়ুর এর প্রজনন ঘটতে দেখা গেছে। এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। 

★পরিযায়ী পাখি বাঁচাতে প্লাস্টিক ব্যবহার ও দূষণ বন্ধ করে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।
★অতিথি পাখির বাসস্থান ও প্রজননের অনুকূল পরিবেশ রক্ষা করা। 
★আইনের ফোঁকর দিয়ে কিংবা কোস্ট গার্ডের চোখে ধুলো দিয়ে যারা অতিথি পাখি শিকার করছে, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। 
★পরিযায়ী পাখিদের বিচরণ এলাকায় হাঁস-মুরগির খামার না করা।


সুমনা ইসলাম
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

তথ্যসূত্রঃ
সমকাল,বিডিনিউজ২৪,প্রথম আলো,ভোরের কাগজ,মানবজমিন,কালের কন্ঠ,আনন্দবাজার পত্রিকা, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী,অনলাইন নিউজ। 

1 টি মন্তব্য: