সুন্দরবন, বাংলাদেশের এক প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ!
যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বরাবরই সুন্দরবন মাতৃসুলভ আচরণ করে আসছে। এবারও ঘূর্ণিঝড় 'আম্পান' বাংলাদেশের লোকালয়ে আঘাত হানার আগেই তার প্রবল শক্তি হ্রাস করে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে সুন্দরবন। আর এই কমানোর মাত্রা কতটুকু তা কলকাতার ক্ষয়ক্ষতির সাথে তুলনা করলেই বোঝা যায়।
সুন্দরবন কতবার যে ঘূর্ণিঝড়, ঝড়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। অত্যন্ত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ থেকে রক্ষায় এবারও বুক পেতে দিল সুন্দরবন। প্রথম আলোর রিপোর্ট বলছে , সুন্দরবন না থাকলে 'আম্পান' ঢাকাকেও লন্ডভন্ড করে দিতো।
সুন্দরবন দেশের উপকূলকে কালাপাহাড়ের মতো আগলে রেখেছে সবসময়। সুন্দরী-গেওয়াসহ নানা বৃক্ষের মজবুত বেষ্টনী আর অসংখ্য নদীনালা বছরের পর বছর ধরে প্রাণী ও সম্পদ রক্ষা করে আসছে। নিজে ক্ষত-বিক্ষত হলেও উপকূলের তেমন ক্ষতি হতে দেয়নি।
শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ঠেকাতে এর আগেও ঢাল হিসেবে কাজ করেছে সুন্দরবন। বিশেষ করে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার তাণ্ডব থেকে এই বন উপকূলকে রক্ষা করেছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ও ফণি থেকেও রক্ষা করেছে সুন্দরবন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি অ্যান্ড উড টেকনোলজির সাবেক ডিসিপ্লিন প্রধান প্রফেসর ড. মো. ইনামুল কবীর বলেন, সুন্দরবন আমাদের রক্ষা কবজ। সুন্দরবনের জন্ম হয়েছেই আমাদের রক্ষা করার জন্য। এ বন আমাদের কাঠ দেবে, সম্পদ দেবে এজন্য এর জন্ম হয়নি। এগুলো আমাদের বাড়তি পাওনা। গাছের মূল ভূমিকা অক্সিজেন দেওয়া, ঝড়-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করা। এর ফাঁকে ফাঁকে আমরা কিছু সম্পদ আহরণ করি। গাছের মূল ভূমিকা পালন করতে হবে বলেই সুন্দবনের বাংলাদেশের এই লোকেশনে অবস্থান। বাংলাদেশে ঝড় প্রবেশের মুখেই সুন্দরবনের অবস্থান। এর কারণে ঝড় প্রবেশ করতেই বনে বাধার সম্মুখীন হয়। সুন্দরবনের জন্মই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার জন্য।
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবন আসলে নিজের ক্ষয়ক্ষতি করে আমাদের রক্ষা করে। আমরা যদি পরবর্তীতে বনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না করি তাহলে সুন্দরবন নিজেস্ব প্রাকৃতিক ক্ষমতা বলেই সকল ধরনের প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এর জন্য বাড়তি কোনো যত্নের প্রয়োজন হয় না।
এ ভয়ঙ্কর দুর্যোগটি সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, বাংলাদেশের জীবন বা সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি থেকে এবারও রক্ষা করেছে সুন্দরবন। আর তাইতো সুন্দরবন রক্ষাকারী পরিবেশবাদীরা আবারো মনে করিয়ে দিলেন উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট কেন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, যতবার সুন্দরবন আমাদের এভাবে রক্ষা করেছে ততবারই আমরা এর অবদানের কথা স্মরণ করি কিন্তু পরে সেটা আবার ভুলে গিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মাদকীয় মোহে বৈশ্বিক ও স্থানীয় উদ্বেগ ও পরামর্শ উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কৌশলগত পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপাল, তালতলি ও কলাপাড়ায় বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বহুমুখী ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পায়ন চালিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ হই।
অথচ ইতিমধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি কর্তৃক সুন্দরবনকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যে’র তালিকায় অন্তর্ভূক্তির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারপরও ‘নিজের পায়ে কুড়াল মারা’র মত সব উদ্বেগ-উৎকন্ঠা উপেক্ষা করেই ‘সুন্দরবনের বিনিময়ে উন্নয়ন’- এর এই প্রক্রিয়া বহাল রেখে বাংলাদেশের উন্নয়নের আশায় মেতে আছি।
ইউনেস্কোর শর্ত উপেক্ষা করে ভারতের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতেই বনের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে ঘটছে একের পর এক পণ্যবাহী জাহাজ ডুবি; প্রাকৃতির জীব বৈচিত্র্যকে ফেলছে বিপর্যয়ের মুখে। মংলা বন্দরের হারবার সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি এক হাজার মেট্রিক টন কয়লাবোঝাই লাইটারেজ জাহাজ এমভি আইচগাতি ডুবে যায়। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ শ্যালা নদীর ধানসাগর এলাকায় এক হাজার ২৩৫ টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় কার্গো জাহাজ এমভি জাবালে নূর, ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর ৫১০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে পশুর নদীর চিলা এলাকায় খাদ্য গুদামের (সাইলো) কাছে ডুবে যায় কার্গো জাহাজ এমভি জিয়ারাজ। একই বছর পশুর নদীর হারবারিয়া এলাকায় সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল জিপসাম নিয়ে ডুবে গিয়েছিল এমভি সি হর্স। বড় বিপর্যয় ঘটে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বরে। এদিন চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যায়। এতে তেল ধীরে ধীরে সুন্দরবনের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। এতে বনের জীববৈচিত্র্য ও মাছের উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
মূলত ভারতের অতি উৎসাহে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সুন্দরবনের ভারতীয় অংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করে তারা বাংলাদেশ অংশ নির্মাণে ব্রতী হন। প্রতিবেশিকে খুশি রাখতেই সুন্দরবনের পাশে পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এতেই ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবন।
দেশের তেল গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণা করেন এমন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ ও অধ্যাপকরা অভিযোগ করছেন ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক চক্র নানা চক্রান্তে সক্রিয়। বাংলাদেশের পাট শিল্প ধ্বংস করে যারা ভারতে পাটকল নির্মাণে উৎসাহী হয়েছিল; তাদেরই কেউ কেউ এই চক্রান্তের নেপথ্যে। রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবনের বুক চিরে তেলবাহী ট্যাংকার ও মালবাহী কার্গো জাহাজ অবাধে চলাচল, একের পর এক জাহাজ ডুবি, মাঝে মধ্যে বিষাক্ত ফার্নেস অয়েল নদীতে সয়লাবে ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনের ত্রাহি অবস্থা।
সূত্রমতে, অপরিকল্পিতভাবে এবং পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে সুন্দরবন এলাকায় কয়লা ভিত্তিক ভারী শিল্প স্থাপন এবং একের পর এক জাহাজ ডুবি ও সর্বশেষ কয়লা বোঝাই কোষ্টার ডুবিতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য মারাত্মাক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এতে সুন্দরবনের বণ্যপ্রাণী সহ নদীতে বাস করা প্রাণীর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। বিভিন্ন সময় এ ধরনের বিষাক্ত কালো তেল ও কয়লা ধোয়া পানি দূষণ ঘটায় এবং এতে যেমন পানিতে বসবাসরত প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি নদী খাল সংলগ্ন উদ্ভিদের সংস্পর্শে এসে সেই তেল শ্বাসমূল, পাতা গুল্মরাজির ক্ষতি করে। আর তা খেয়ে বনের প্রাণীকূলের ক্ষতি হয়ে থাকে। বিপন যেন পিছু ছাড়ছে না সুন্দরবনের। মানুষকে রক্ষা করছে যে বন, সেই মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনায় হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবন। এজন্য মানুষের অসচেতনতা ও বন বিভাগের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রকৃতির দান সুন্দরবনকে তার আপন গতিতে চলতে বাধা সৃষ্টি এবং সুরক্ষায় বাস্তবমুখী প্রকল্প গ্রহন না করায় সুন্দরবন যেন কাঁদছে। যে সুন্দরবন প্রকৃতির রূদ্র রোষ থেকে মায়ের মত আগলে রাখে উপকূলীয় অঞ্চলের জনপদকে তাকে যেন আর কৃত্রিম সংকটে ক্ষতবিক্ষত না করা হয় এমন দাবি আমাদের সকলের। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশ্ব যেখানে সদা জাগ্রত সেখানে অভ্যন্তরীনভাবে সুন্দরবন সুরক্ষায় বিশেষ কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। এরকমটা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরপর হয়তো 'সিডর' 'বুলবুল' 'আইলা' 'নার্গিস' 'ফণী' 'আম্পান' এর মতো দুর্যোগ গুলোয় লন্ডভন্ড হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
তথ্যসূত্রঃ অনলাইন পত্রিকা,উইকিপিডিয়া।
সুমনা ইসলাম



Post a Comment