ইসলাম এবং প্রগতি চর্চা কি পরস্পর বিরুদ্ধ?

যদি বলি একটা ধর্মকে বার বার প্রগতির বিরুদ্ধে এনে দাঁড় করানোটা আসলেই প্রগতি বিরুদ্ধ ব্যাপার। খুব ভুল কিছু বলা হবে বলে মনে হয় না। একটা ধর্মের মানুষ, বিশ্বাসী মানুষ প্রগতিশীল হতে পারেনা এই সংকীর্ণতা যতোক্ষণ সমাজে থাকবে ততোক্ষণ প্রগতির পথে যে কেউই নেই সেটাই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হবে। সংখ্যার হিসেবে যেমন ১০% কে বাদ দেওয়া যায় না তেমনি ৯০% কেও বাদ দেওয়া যায় না বরং উভয়ই সমাজের অংশ। আপনাকে যদি ভাবতেই হয় তবে উভয় অংশকে নিয়েই ভাবতে হবে। কোন একটি নির্দিষ্ট অংশকে বাতিল করা আসলে প্রতিক্রিয়াশীল চর্চা। এই উপমহাদেশে মুসলিম পরিচয় বার বার নিগৃহীত হয়েছে, নিপীড়িত হয়েছে। ম্লেচ্ছ, জবন, অচ্ছুৎ বলে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। এই নিপীড়নের যন্ত্রণাকে ধারণ করে এই উপমহাদেশের মুসলিম পরিচয়ের মানুষের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। একটি হচ্ছে সাম্প্রদায়ীক হওয়া আর অন্যটি হচ্ছে অসাম্প্রদায়ীক হয়ে সামগ্রীক সমস্যাটাকেই একটা চ্যালেঞ্জের মুখে ছুঁড়ে দেওয়া। মুসলিম লীগের উত্তোরণ ঘটে মুসলিমদের এই নিপীড়নের যন্ত্রণাকে ব্যাবহার করে সাম্প্রদায়ীক রাজনীতির মাধ্যমে যা পাকিস্তান গঠনের পর ব্যর্থ হয়ে যায়। আওয়ামীলিগের জন্ম আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম ধরে হলেও তা পরবর্তী সময়ে এসে আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাংলাদেশি মুসলমান গ্রহণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা আরোও বিকশিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় এবং অপাংক্তেয় হয়ে পরা ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে টেনে তোলা হয় শুধু মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার লক্ষেই। বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান রাষ্ট্রের দগদগে ঘা ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে 'মুসলিম বাংলা' প্রতিষ্ঠার লক্ষে তবে এবার নিপীড়কের ভূমিকায় এসেছেন আমাদের প্রগতিশীল দাবি করা মানুষগু লো। বিবরণে-বিবৃতিতে অচ্ছুৎ কিংবা ম্লেচ্ছ কিংবা জবন বলার বয়ান এখনো চলছে। হয়তো তারা বুঝছেন না, আঘাত কখনো আঘাতের দাগ মুছে দেয় না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফল অবশ্যই ভয়াবহ কিন্তু যারা এই রাজনীতি করেন তারাও কিন্তু এই রাষ্ট্রের একটা অংশ এবং একটা সংখ্যক মানুষের প্রতিনিধি ফলে বিনা আলোচনায় তাদের খারিজ করা কিংবা তাদের নিয়ে বিব্রত হওয়া সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে আরোও ভয়াবহভাবে শক্তিশালি করবে। যে পক্ষই হোক না কেন আপনাকে ব্যবহার করে গাছেরটাও খাবে এবং তলারটাও কুড়োবে। ধর্মীয় পরিচয়, কওমী মাদ্রাসায় পড়াশোনা, হুজুর, মৌলবি দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে ওঠা, তাদের সাথে মিটিং- মিছিল বয়কট করা কিংবা হাসি তামাশা করা কখনোই এই সংকটের সমাধান করবে না বরং সমস্যা আরোও ঘণীভূত করবে। এই সংকটের সমাধান করতে হলে সামাজীক অভিজ্ঞতা বিনিময়, বোঝাপড়া, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ এবং চিন্তার আদান-প্রদান জরুরী। 'ওয়্যর অন টেরর' এর নাম নিয়ে চলা পশ্চিমা ক্রুসেড, উপমহাদেশ জুড়ে চলা বিজেপির হিন্দুত্ববাদের হুংকার এখানকার মুসলমানদের বরাবর কোনঠাসা করে রেখেছে, বস্তুত বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও উপমহাদেশ বিচারে মুসলিমরাই এখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। বাংলাদেশ এবং পুরো উপমহাদেশ জুড়ে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল তাকে রিপ্লেস/প্রতিস্থাপন করে এখানে কট্টরপন্থার ইসলাম প্রতিষ্ঠার পেছনে কারন অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে সারাবিশ্ব জুড়েই কট্টোর পন্থার ইসলামকে হাজির করা হয়েছে যা আসলে কারযত 'ওয়্যর অন টেরর' এর নামে হত্যাযজ্ঞ চালানো কর্তৃত্ববাদী শক্তিরই চালানো প্রোপাগান্ডার ফল। উদার ইসলামকে রিপ্লেস/প্রতিস্থাপিত করে চরমপন্থি জেহাদি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এই কর্তৃত্ববাদী শক্তিরই লাভ, ইসলামের বিরুদ্ধে , মুসলিম পরিচয়ের বিরুদ্ধে তাদের ক্রুসেড বৈধতা পাবে তাহলে। এবং যুদ্ধের ব্যবসা কে পুঁজি করে তারা তাদের আখের গুছিয়েই যাবে। এই সময়ে প্রগতিশীল চিন্তার যে কোন মানুষের উচিৎ মুসলিম পরিচয়কে, ইসলামকে কিংবা এইসব সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বলি হওয়া মানুষগুলোকে খারিজ না করে, বিব্রত না হয়ে বরং আলোচনায়, বোঝাপড়ায় আরোও এগিয়ে আসা এবং পশ্চিমা প্রগতিশীলতা চর্চার বাইরে গিয়ে নয়া বয়ান সৃষ্টি করা।
ইসলামি ভাবধারার রাজনীতি যারা করেন তাদের বড় অংশটাই আবার ইসলামকে ব্যাবহার করতে চান ক্ষমতার ভাগিদার হওয়ার স্বার্থে ফলে বরাবর সমস্যা থেকে উত্তোরণের পথে এগুনো যায়নি, ইসলামিস্টদের প্রগতিশীল অংশকেও কেউ স্পেস দেওয়ার চিন্তা করেনি বরং রুদ্ধই করা হয়েছে। ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত উপনিবেশিক ধ্যান-জ্ঞানেই ধর্ম চর্চা করার কারণেও মানুষের মুক্তির পথ রুদ্ধ হয়রছে। সামগ্রীকভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে এখানে ক্রিয়াশিল বেশিরভাগ চিন্তক বুঝে কিংবা না বুঝেই পশ্চিমা এজেন্ডাকেই বাস্তবায়ন করেছেন। ইহুদী-নাসারা কিংবা পশ্চিমা মিডিয়ার সৃষ্টি বলে অনেক নিরেট জ্ঞান চর্চাকেও রুদ্ধ করা হয়েছে আবার সাম্প্রদায়িক শক্তি বলে মুসলমানদেরও অপাংক্তেও করার চেষ্টাও জারি রয়েছে। এই সমস্ত সংকট মোকাবেলার সদিচ্ছা থাকলে এই উপমহাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমা চিন্তা, মুসলিম, নন মুসলিম, সেকুল্যার চিন্তাকে এবং সাম্প্রদায়িকতার সাথে ক্ষমতার সম্পর্ককে নতুন করে প্রশ্ন করতে হবে। ক্ষমতার প্রশ্নে, মানুষকে মানুষ বলে গণ্য না করে এসব নিত্যনতুন সংকটকে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সাম্প্রদায়িক বলে কাউকে অচ্ছুৎ করে দেওয়ার ছুৎমার্গ কোন কালেই ভাল ফলাফল দেয়নি একই সাথে ইসলামিক চিন্তকদের ভাবতে হবে যে জেহাদি ভাবধারা দিনশেষে মুসলিমদের লাভ না করে ক্ষতিই করে যাচ্ছে এবং এই উপমহাদেশে যারা কট্টোর ধর্মীয় রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন তারা দিনশেষে মুসলিম এবং ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা কেই শক্তপোক্ত করছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তাবেদার ভুমিকা নিয়েও সচেতন থাকতে হবে বলেই আমার অভিমত।
বিদ্রঃ এই আলাপে আলোচনা-সমালোচনার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে, আপনারা যদি অংশ গ্রহন করেন তবে চিন্তায় পরস্পরই সমৃদ্ধ হবো। ধন্যবাদ।


1 টি মন্তব্য: